Friday, April 8, 2011

পূর্ণপ্রজ্ঞা

(1)

গরমে বেশ হাঁসফাঁস দশা। এই শেষ বোশেখের আবহাওয়ার এমন খামখেয়ালী ধরণে অস্বস্তি বাড়ছে। ধূলোমেঘের লালচে আভাস নিযে থমকে আছে আকাশ। কখনো হাওয়া চলছে জোরে অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। পূর্ণা বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাত এখন দুটো। সদ্য কেনা এই ফ্ল্যাটটা ওর ভারী পছন্দের। নাম দিয়েছে অবশেষে।খুঁজে-খুঁজে দেখাশোনা চালাতে-চালাতে হযরান ওরা যখন আশা ছেড়ে দিযেছে, প্রায় তখনই এটা পেল। আর রেজিস্ট্রী হল যেদিন, সেইদিন সৌভিক ঘরে ঢুকেই ধপাস করে বসে পড়ে লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললো- উঃ, অ-ব-শে-ষে....... ব্যস্, পূর্ণার মনে বাড়ীর নাম স্থির হয়ে গেল-অবশেষে। কত দিন ধরে ওরা বাড়ী-বাড়ী করে যে পাগলের মত ঘুরেছে। যদিও এই ফ্ল্যাট কিনতে গিযে পেরোতে হল টালবাহনার অনেক এঁদো গলি, তবু তো হল। আসলে সৌভিক চেয়েছিল খরচা করছি যদি, তবে শহরের হার্টের কাছে না হলেও লান্সের কাছে থাকি এ্যাটলিস্ট। আবার পূর্ণারও সেই একই যুক্তি। এত পয়সা যাচ্ছেই যদি তবে সারাদিনের শেষে কেন না একটু প্রকৃতির কাছে এসে দাঁড়াই। নাগরিক সুবিধেও থাকবে আবার গাছ, পাখী, নির্জনতা.......য়দিও এ জাযগাটা খুব তেমন নয়, তবুও এখানে একটা অন্যধাঁচের ভালো লাগায় পূর্ণা মুগ্ধ হযেছিল। মনের ওপর ভাস্কর্য উপভোগের তৃপ্তি একদম জড়িয়ে-মড়িয়ে সাপ্টে নিযেছিল ওকে। শিল্পীর আঁকা তুলিতে সেজে একটা ফ্লাইওভার, অসম্ভব এ্যাট্রাকটিভ ওয়েতে হাল্কা লিফ্ট নিয়ে উধাও হয়েছে বাঁদিক থেকে ডানদিকে, কমপ্লেক্সের মাত্র শ-দুয়েক ফুট দূর দিযে। আর ওটাই প্রতিপার্শ্বকে একটা এলিগ্যান্ট লুক দিয়ে দিযেছে এমন ষেন ওটা কংক্রিটের নয়, নমনীয মোম বা মাটীর কোনো আর্টওয়ার্ক। কত সুন্দর এর খাঁজ-ভাঁজ-বাঁক। আবার রাতে যখন স্ট্রীটল্যম্পগুলো জ্বলে বা দূর থেকে আলোজ্বলা মুখে গুনগুন গানে গাড়ীগুলো ছুটে যায়, তখন ঐ গতির সঙ্গে পূর্ণাও কিভাবে যেন জুড়ে যায়। একটা গাড়ী গেল, তারপর পরের গাড়ী, পরের গাড়ী............এমনি একটা অপেক্ষা-অপেক্ষা খেলা চলে আনমনে। এ খেলার মজায় ওর গড়িয়ে যায় সময়। ভাবে আসবে না, এখানে বসবে না, তবু এক অন্য মুখরতা, অন্য এই পাওয়া থেকে সরাতেও পারেনা নিজেকে। সারাদিনের অফিসক্লান্ত দিনের শেষে এই বারান্দা, এই পুল কত কথা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে ওর জন্য। বাড়ী ফিরেই ঢোলকা হাইসকোটটা গায়ে গলিয়ে পূর্ণা সোজা এখানে এসে আগে দু-দন্ড দাঁড়ায়, তারপর অন্যকাজ, তারপর চা-পেপার-সৌভিক............

কিন্তু আজকের দিনটা আলাদা। সৌভিক ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। ও যে হাল্কাফুল্কা আছে তা জানান দিচ্ছে রেকর্ডারে বাজতে থাকা গান। ওর ঘরে গান চলছে জোর। এখনকার সিচ্যুয়েশনটার সঙ্গে একটু আগের সময়টার কত তফাত্। কোনো ব্যাখ্যা নেই এর। সন্ধ্যেয় সৌভিক যখন ফিরলো, পূর্ণা দরজা খুলে হাত বাড়িয়েছিল ব্যাগটা নিতে। কিন্তু পাশ কাটিয়ে সৌভিক ঢুকতে-ঢুকতে বললো- না, না, ঠিক আছে...... আজ রাতে পার্টী আছে না? একষ্ট্রা চাবীটা সঙ্গে নিয়ে বেড়োলে ভাল। আমি থাকছি না। So…’

কি সাবলীল ভঙ্গীমায় অবহেলার উচ্চারণ সৌভিকের। পূর্ণা তাকিযে থাকলো কিছুক্ষণ। মনে করার চেষ্টা করলো এই ভাববাচ্যে বলাটা ও কন্টিন্যু করছে কদ্দিন। হ্যাঁ, তা প্রায় মাস সাতেক হল বোধহয়। যে অবশেষে পূর্ণার সুখ, স্বপ্ন, আগামী দিন, সেখানে ঢোকার মাস পাঁচেক পর থেকেই এমনি করে সম্পর্কের অবশেষে এসে ঠেকতে হবে তা বোঝেনি ও।

পার্টীতে আজ ইনভিটেশন পূর্ণার। নিকি-র পোস্ট হাই হয়েছে, তাই একটা পার্টী দিচ্ছে হায়াত-এ। ভেবেছিল আজ সৌভিক আসছে.....যাবে না। সেইমত জোরদার মিথ্যে সাজিয়ে ভিনিত-কে ফোনও করে দিযেছিল। যে শাড়ী-সাজে পূর্ণাকে দেখতে চেয়ে সৌভিক আবদার করতো প্রায়ই, সেই ওর দেওয়া শাড়ীটাই আজ পরেছিল পূর্ণা, অথচ..............

নাঃ, আর ভাববে না, ভাবার দরকার নেই। যা যাচ্ছে তা যাক। এই মূহুর্তেই স্থির করে নিল- ও যাবেই। পূর্ণা ঘরে ঢুকে দরজা দিল, আলমারী থেকে লাইক্রা মেটিরিযালের ফ্লোযিং লং স্কার্টটা বার করল। ম্যাচিং জুতোই এর সঙ্গে একমাত্র খাপ খায় ভেবে 16 জোড়ার থেকে বাছাই করে এক সেট পরলো ও দরজা খুলে বাইরে এলো যখন, তখন পাশের ঘরে গানের আওয়াজ আর নেই। ঘরের হাল্কা সবুজ আলোটা জ্বলছে। সৌভিককে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো শুয়েছে। যা খুশী হোক। ভাববে না, আর ভাববে না ও। সৌভিকমুক্ত মন চাই পূর্ণার। না হলে আর যোঝা যাচ্ছে না। হ্যাঙ্গার থেকে ডুপ্লিকেট চাবীটা নিয়ে পূর্ণা বাইরের দরজার ল্যাচে হাত রাখলো।

(2)

পূর্ণা। কি সুন্দর নাম আনুর। মাঝেমাঝে মনে হয, নামের প্রতি জাস্টিফিকেশনকে মজবুত করতেই কি ও এমন? সৌভিক বলত-এত তুমি মনে রাখো কি করে? এটা রাখছো, সেটা গোছাচ্ছো, কি নেই তা আনাচ্ছো......আনু, আনু, একলা আমার কাছে একলা তুমি আনু। পূর্ণা থাকো তুমি অন্য সকলের কাছে।

সৌভিকের আজও মনে পড়ে, যখন আনুর সঙ্গে আলাপ হল কলেজে, তখন ১০ জনের মধ্যে থেকে কি অসামান্য দক্ষতায় ও মন কেড়েছিল। সবাই কলকল করে কথা বলছে, ব্যস্ত নিজেকে জাহির করছে, অথচ আনু সোবার, ইন্টেলীজেন্ট, হাস্যোজ্বল......... একদম পরী যেন। যা বলত, যা করত, তাই ওর চেতনা-বুদ্ধির রাস্তা পেরিয়ে নামত। উচ্ছ্বলতাকে ডিগনিটির সাথে হ্যান্ডল করতে কতবার যে দেখেছে ওকে। তেমনি কেয়ারীং-ও। একবার তো ছ-সাতজন বন্ধু মিলে ওরা হাঁটছিল, রূপম্-এর জামায় দিল কাকে পটী করে। ছিল সবাই, কিন্তু আনুই সঙ্গেসঙ্গে নিজের রুমাল ভিজিয়ে এনে ওর জামা খুলে মুছে দিয়ে তবে শান্তি। কোনো বন্ধুর ম্যাগাজিনে ছবি বেড়িযেছে, আনু পয়সা খরচ করে কিনে এনে হৈ-চৈ জুড়ে দিল। য়েন ওটা ওর নিজের এ্যাচিভমেন্ট, নিজের ছবি। পিকনিকে গিযে কোমর বেঁধে রাঁধতে বসল একাই। সবাই ওর রান্নায় মুগ্ধ, আর সৌভিকের তো কথাই নেই, কতবার যে একথা বলেছে ওকে। কিন্তু এখানে কেন আনু? বাকীরা কেমন এনজয় করছে দেখ.......হাল্কা-ফুল্কা ভাসছে.....’আমিও তো ভাসছি, তুমি যে আছ........ সৌভিকের প্রশ্নের উত্তরে আনুর যুক্তিতে কথা থেমেছিল ওর। সারাক্ষণ একটা গোধুলীর আলোর মতন ঠোঁটজুড়ে হাসি ওর ঝুলেই থাকতো। কি যে মন ভাল করে দেওয়া গেছে সেসব দিন। বাড়ী ছেড়ে, মাযের মনোযোগ ছেড়ে, মফস্বলের শান্ত জীবন ছেড়ে এখানের পেয়িংগেস্ট-জীবনকে বওয়া যাচ্ছিল শুধু আনু ছিল বলে। বালিশের ওয়্যার তেলচিটে? একদিন দেখল বিছানার চাদর, ওয়্যার, মায় কুশনকভার সুদ্ধু একই ডিজাইনে সাজুগুজু করে বসে আছে, যেন ব্যাচেলার্স রুম নয় কোন তিন তারা হোটেলের ঘর। ভাঁড়ারে কী নেই কী আছে, ওয়ার্ড্রোবে কত কী জামা-প্যান্ট তার ম্যাচিং টাই, তা ধীর-ধীরে ভুলে যেতে থাকলো সৌভিক। ওকে ভাল দেখতে চাওযার ইচ্ছেগুলো নিয়ে অন্তরীক্ষ থেকে কোনো এক পরী ভরে রাখতো সবকিছু। নিশ্চুপে, মমতায়।

ঠিক..........মমতায়, ভালবাসায় নয় বোধহয়। তা যদি হত তবে এভাবে ওকে পারতো অগ্রাহ্য করতে, কথা না শুনতে? বিশালদের পার্টীতে কি সুচারু দক্ষতায় সেদিন নাচলো আনু ভ্রমরের সঙ্গে। আনু জানে ও এসব পছন্দ করে না। তবু............

যে আনু অভাবগুলো বুঝতে না দিয়ে নিশ্চুপে গুছিয়ে দিত সব, আজ সে তীব্র মুখর। প্রতিটা কাজ ও আজ জানান দিয়ে করে। সঙ্গে আবার প্রচ্ছন্নভাবে জড়িয়ে থাকে তাচ্ছিল্য-কাঁটার বিষ। তা ভয়ানক, তা অসহ্য। ওর জোর, জেদ, বুদ্ধি সবই সৌভিকের চেযে যেন কয়েক যোজন এগিযে নিয়ে ও জন্মেছে। আনু বোঝেইনি- যা সৌভিক মেনেছে, মানিয়েছে, ছেড়েছে, তার সবটা ওকে ভালবেসে, প্রশ্রয়ে। সৌভিক কি-কি পারে না তাই ধীরে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কি পারে তা ছেড়ে। অথচ সৌভিকের ভালবাসায তো কোনো শর্ত ছিলনা। বিয়ের পর থেকে খুব দ্রুততার সঙ্গে আনু বিয়েটাকেই চ্যালেঞ্জ করতে-করতে চলেছে। অফিসের কাছাকাছি থাকলে সময় বাঁচবে, অর্থ বাঁচবে ও সবচেয়ে বড় ড্রাইভিং করার ঝক্কি বাঁচবে ভেবে যখন লেকগার্ডেন্সের ফ্ল্যাটটা কিনতে মনস্থ করলো, তখন আনুর তা পছন্দ হল না। ওর পছন্দের গাড়ীর রং আনুর পছন্দ নয়, লাল রং নাকি চাইল্ডিস। আনুকে প্রেজেন্ট করা ওর শাড়ী আউটডেটেড। ওর ইনট্রোভার্ট ধরণ, ওর অগোছালো ইনোসেন্সী, ওর পছন্দের খাদ্যতালিকা- সব নিয়ে আনু ভীষণ রকম সরব। মানুষের চেহারায় যেন প্রাণী একটা ও। অফিস ফেরত্ দূর সাউথ ক্যালকাটা থেকে উল্টোডাঙার মোড়, বাগুইআটী, কেষ্টপুরের মোড়ের জ্যাম পেরিয়ে গাড়ী চালিয়ে আসা যে কি অপরিমেয যন্ত্রণার তার আন্দাজটুকুও আনুকে দিতে পারলো না কখনো। হাসিখুশী আনুর পরী-পানা মুখ আজকাল বাদল মেঘে ছাওয়া- সারাক্ষণ।

সেই আনুকে আজ সত্যিই পরীর মত লাগছিল। দরজা খুলে যখন হাত বাড়ালো, তখন দেখেছিল আনু ওর দেওয়া সেই শাড়ীটা পরে আছে। ঘরোয়া, মিষ্টি, শান্ত, কেয়ারিং সেই পুরনো, হারানো মেয়েটা- আবার। অথচ কি যে হল ওর নিজের.......। পুরনো দিনের মন উবজে উঠতেই যত রাজ্যের অভিমান ফের উজিযে এলো কোত্থেকে। ওর হাত সরিয়ে নিজেই ঢুকল ঘরে, আহ্লাদের বদলে আঘাত দিল। অথচ এতদিনের চেনার পরেও আনু কেন বুঝল না? আনুর কথা ভাবে বলেই না ওর মনে ছিল আজ আনুর পার্টী, আনু ভালবাসে হাসতে, মজা করতে, নাচতে। ওকে ধাক্কা দিয়ে সৌভিক যা কিছু করে, তা চতুর্গুণ ধাক্কা হযে ওর নিজের কাছে ফেরে। বাইরের আচরণের নীচে চুপিসাড়ে কাঁদা ওর এই কষ্ট তো দেখতে পায়না আনু। কেন? কারণ ভালবাসবার একটা সেটপীস্ ও সাজিয়ে রেখেছে মনে এবং সেইমত আনু চলে, চালাতে চায়। এ আরেক অসম্ভবের গান, আরেক অন্য তিতকুটে স্বাদ- জীবনের। হার, হার। সবক্ষেত্রে গো-হারান হারই এখন নিয়তির মত পিছু নিয়েছে ওর। অন্তরে নিরন্তর কান্নার শব্দ আজ মুখর হতে চায়। তাও কী পারে, তাও কী পারলো সৌভিক- সেইভাবে?

(3)

বাইরে বেড়িয়েই একটা অটো নিল পূর্ণা। চলে গেল সোজা বাস টার্মিনাস। ওখানে য়ে বাসটা গড়িয়া হয়ে বারুইপুর যাবে তার একটা মনমত সীটে বসলো। ফাঁকা বাস। সবে দুএকজন করে উঠছে, কেউ এদিক-ওদিক দেখে আবার নেমেও যাচ্ছে। অতিরিক্ত ফাঁকায় অতিরিক্ত দিশাহারা আর কি। এই বাস না অন্য বাস না ঐ সীট এই টানাপোড়েনের সব মানুষজন। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে ও- আলগোছে ঘটনার স্রোত বয়ে যায়। মন শুধু সাপ্টেজাপ্টে এখন ছুঁয়ে আছে নিজেকে। মিনিট 10 বাদে গাড়ী ছাড়লো যখন, তখন এতই আনমনা ছিল, যে হুঁস ফিরলো কন্ডাক্টরের ডাকে। গাড়ীর লাস্ট স্টপেজ অবধি একটা টিকিট কাটল পূর্ণা। ব্যস্, কেটে গেল রেশ। অতলান্ত শূন্যতাবোধের মজায আর থাকা গেল না। বেরসিক কন্ডাকটর দিল ধ্যানীর ধ্যান ভাঙিয়ে। বাসের ভিতরের এই য়ে নির্দিষ্ট ডেস্টিনেশনে যাবার মানুষজন, এসবের দিকে মন যেতেই ওর উথলে, উপছে গেল আবেগ- কান্নায়, যন্ত্রণায়, ধিক্কারে। এতগুলো মানুষের মধ্যে একমাত্র ওই দিশাহীন, উপায়হীন, গন্তব্যহীন নৌক? যাকে ভালবেসে পড়াশোনা ছাড়ল, সহয়োগ দেবার তীব্র চাওয়া নিয়ে চাকরীতে ঢুকলো সে আজ এমন? সৌভিকের উচ্চাকাঙ্খাকে উচ্চাসন দেবে বলে লোন নিযেছিল অফিস থেকে, আজও যা শুধছে পূর্ণা। সৌভিককে খুশী করতে পূর্ণা ছেড়েছে বেঁচে থাকবার নিজস্ব ছন্দ। আনন্দমাখা হাসিখুশী ঢঙে ও যেভাবে ছিল এতকাল, তা সৌভিকের অন্তর্মুখী স্বভাবের কাছে অতি প্রগলভ, হাল্কা, অপছন্দের। তাই হাসি ছেড়ে দেঁতোহাসি শিখেছে, নাচ ছেড়ে ভান শিখেছে। অথচ এই সেদিনের পার্টীর পরেও সৌভিক......। আজকাল ও নাচেনা, হাই-হ্যালো-তেই থেমে যায়, কিন্তু বিশালতো আলাদা। বিশাল সৌভিকের খুড়তুতো ভাই, তাছাড়া পার্টীটাও পারিবারিক। সে জানে পূর্ণা ভাল নাচে। তাই পার্টীতে যখন হাত ধরে ওকে ডান্সফ্লোরে নিয়ে গেল, তখন বহুদিনের অবদমনের পরে পূর্ণা মনপ্রাণ খুলে নেচেছিল। বিশাল, ভ্রমর, সেঁজুতি, অনন্য- সব্বার সঙ্গে.......চুটিয়ে। কিন্তু বাড়ী ফিরে সৌভিকের অফ মুড আর অনুয়োগের সামনে পড়ে হতচকিত পূর্ণা খুঁজেছিল- এ কোনজন? এই নাচের জন্যেই ওকে যে প্রশংসায় ভরিয়ে রাখতো- সে? এ কি সৌভিকের কন্ফিউশন, জেলাসী না ওনসেল্ফ-এর ওপর থেকে উঠে যাওয়া বিশ্বাস? জানেনা। আজ কিচ্ছুর উত্তর খুঁজে পায় না পূর্ণা। ও প্রিয কতকিছু ছাড়ল কারণ সৌভিক ছাড়া সারা বিশ্ব ওর শূন্য ছিল বলে। অথচ সৌভিক? নিজের কাজ, পড়াশোনা, চাহিদা, স্বার্থ ও তৃপ্তির বাইরে কি একবারও তাকালো চোখ তুলে? জানতে কি চাইলো কখনো- এই ত্যাগ পূর্ণার জীবন থেকে কত কী মণিমুক্তো গড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। অবশ্য কেন জানবে? সে বোধের জাযগাটা তো পূর্ণাই তৈরী হতে দেয়নি কখনো। অভাববোধের আগেই সাপ্লাই নিয়ে ও হুজুরে হাজির থেকেছে সমস্তক্ষণ। চাইবার আগেই ও পেতে-পেতে ভুলেই গেল দিতেও কিছু হয় বলে। সৌভিক চায়নি বলে আজও পূর্ণা সন্তানহীন। সৌভিকের সারাটা সময শুধু হিসেব কষেকষে জীবনকে যাপন। এই বয়সে গাড়ী, ঐ বয়সে বাড়ী, তার ই.এম.আই, তারপর সিঙ্গাপুর, তারপর..........

জীবনের প্রতি বাঁকে য়ে আর্ট, বাঁধনের মধ্যেও যে বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত, তাকে ছোট্ কক্ষে ভরতে চেয়েছে হরদম। জীবন ছাড়বে কেন? শোধ তাই এমনি করে সে তুলছে। ক্ষুদ্রতার গন্ডীতে আচমন সেরে বিশালত্বকে বরণ করা যায়না। এত তাড়াতাড়ি তাই ক্যানভাসে উল্টে গেল রং। একা পূর্ণার সাধ্য কি য়ে সবটা মোছে?

: দিদি, আপনি কি নামবেন?

ফের কন্ডাক্টরের ডাক মনস্ক করলো ওকে।

: হ্যাঁ ভাই, এসে গেছে?

: অনেকক্ষণ। আপনি ঘুমিয়ে পড়েননি অথচ নামছেন না দেখে ভাবলাম কি জানি.......।

: না, আসলে শরীরটা হঠাত্ খারাপ লাগছিল।

: আপনি বসুন না, সুস্থ হলে নামবেন।

: না, না ঠিক আছে।

অচেনা বারুইপুরের আধা মফস্বলী জায়গায় নেমে পড়লো পূর্ণা।

নাঃ। এ ভাল লাগছে না। বোকার মত এদিক-ওদিক তাকানো আর উদ্দেশ্যহীন ঘুরঘুর..........

একটা কুকুরও বুঝতে পারে অসহায় এই অবস্থাটা। তাছাড়া রাস্তার মানুষজন ওকে দেখছে তা ও বুঝতে পারল বেশ। এই রাত দুপুরে পয়েন্টেড হিল জুতো, পার্টী ওয়্যার, সফিস্টিকেটেড লুক...........না না, ঠিক হচ্ছে না। এই প্রথম ও ফিল করল চেনা দুঃখ, চেনা বারান্দা, চেনা ঘর, মানুষ এসব অনেক বেটার এই অজানা-অচেনা অনুষঙ্গের চেয়ে। ও তাড়াতাড়ি ফিরে এল বাসে। কন্ডাকটারকে উপযাচক হয়ে বললো-

: শরীরটা আবার খারপ লাগছে ভাই, আমি ফিরবো।

: আমি তখনই বুঝেছিলাম, বসুন দিদি বসুন।

ইতিমধ্যে ওর সীটে একজন বসে গেছে। কন্ডাক্টর তাকে অন্য জায়গায় বসিয়ে ওকে সেই পুরনো সীটেই ব্যবস্থা করে দিল। অকারণ এই মিথ্যে বাহানার ব্যাপারটা পূর্ণার খারাপ লাগলো খুব। কিন্তু উপায়ও নেই। ধরা দেওয়া যাবে না যে।

(4)

রাত দুটো এখন। পূর্ণা ১২ টার মধ্যেই ফিরতে পেরেছিল। ওটা লাস্ট বাস ছিল বলে লোকজন কম, তায় আবার উল্টোডাঙার পর ফাঁকা রাস্তা পেযে গাড়ী হ1ওয়ার বেগে দৌড়েছে। সারাদিনের না খাওয়া বেশ জানান দিচ্ছিল মাথা টালমাটাল করে। বাস থেকে নেমেই তাই ব্যাগে রাখা বিস্কুট খেতেখেতে লিফ্টে উঠে যখন ল্যাচের হাতল ঘোরালো, তখন ফের মনে ধোঁয়ার উদয় হতে দেরী লাগলো না। এই রাত অবধি ও বাড়ীতে নেই, অথচ এতই নির্বিকার সৌভিক? একটা ফোনও তো করেনি। মিউজিক রুম এখন শান্ত। না ক্লাসিকাল না কমার্শিয়াল সাড়া। গুনগুন করে শুধু এসির শব্দ জানান দিচ্ছে ওর উপস্থিতি। এমন অনভিপ্রেত হয়ে ঘরে ঢোকায়, রাজ্যের অসম্মান যেন জড়িয়ে গেল গায়। বাথটাবটা জলে ভরে প্রায ঘন্টাখানেক শুয়ে থাকল, মন তবু অশান্ত। কিছু চায়, কারুকে চায়, কারুর জন্য বাঁচে মানুষ। সেইটা নেই? সত্যি নেই? ও নিজে তো এমন করে শুন্যতায় য়েতে পারেনি? ফিরে এসে তাই আগেই দেখেছিল সৌভিক খেয়েছে কিনা। আজ সৌভিক ফিরবে বলে ওর পছন্দসই রান্না করেছিল,শাড়ী পরেছিল, পার্টী ক্যানসেল করে ভেবেছিল..........ভেবেছিল অনেককিছুই যা এখন ভাবতে ভাল লাগছে না। নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। বারান্দার আলোটা নেভালো পূর্ণা, মোড়া নিয়ে এসে বসলো থামের পাশঘেঁষে, রাস্তা থেকে আসা তেরছা আলোকে আড়াল করে। নাহলে পরের দিন আবার কৌতুহলী কোনো প্রতিবেশীর নাক গলানোর কৈফিয়ত দিতে গিয়ে হয়তো ভদ্র থাকা যাবে না। দরকার কি? তার চেয়ে............

(5)

রাত 11-টা পেরোতেই অস্থির লাগলো সৌভিকের। ঝড়ো হাওযার দাপটে নানান কিছু পড়ছে এদিক-ওদিক.......তার শব্দ আসছে মাঝেমাঝে। খুব অবাক লাগছে এবার। এতটাই কেয়ারফ্রী, এতটাই অবহেলার এ্যাটিচ্যুড্, য়ে এখনো একটা ফোন নেই? ও বিরক্ত ছিল, ভুল করেছে এটা ঠিক, তাবলে আনু বুঝবে না? বিয়ের আগের বছরগুলো আর বিযের পরের এই পাঁচটা বছর তো কম নয়! ওকে তো আজ নতুন চিনছে না। তবে? কেন বুঝবে না?

মনে পড়ে একবার সিনেমার টিকিট কেটে ‘89’-এ অপেক্ষা করছিল আনু। সৌভিকের দেরী হচ্ছিল পৌঁছতে। ফোনে যোগাযোগ রাখছিল, জানাচ্ছিল রাস্তায় জ্যামের কথা........। তবু এসে পৌঁছনোর পর, আনুর শরীরীবিভঙ্গ উচ্চরবে ক্ষোভের যে বিবরণ দিচ্ছিল, তা ভাল লাগেনি ওর। তাও হুড়োতাড়া করে ভেতরে যাচ্ছিল ওরা। আনু বলল, আধঘন্টা আগে শুরু হযে যাওয়া ছবি..........কি হবে আর.......কিই বা বুঝবো........ একটু আগে বেড়লেই যদি........ সৌভিক শেষ হতে দেয়নি কথা। ওর হাত থেকে টিকিট দুটো নিয়ে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল সত্যি তো কি হবে দেখে? আমার প্রবলেমের চেযে সিনেমাটা তো বেশী ইম্পর্টান্ট......কি দরকার........এভাবে? বলেই উল্টোদিকের বাস ধরে সোজা নিজের বাড়ী। কীহোলে চাবী ঢুকিযে তখনো তালাটা খোলা হয়নি, দেখলো আনু ট্যাক্সি থেকে নেমে ছুটতে-ছুটতে ওপরে আসছে। সৌভিকের আজও কানে বাজে আনুর সেদিনের অনুতাপের স্বর, আনুর ক্ষমা চাওয়া, আনুর কান্না। অথচ পরে চিন্তা করতে গিয়ে সৌভিক এই সিচ্যুয়েশনের জন্য কিন্তু নিজেরই দোষ খুঁজে পায়, যা আজও জানায়নি কারুকে, আনুকেও না। আসলে আনুর মনোযোগ, আনুর তীব্র অনুরাগ, আনুর পৃথিবীতে শুধুমাত্র নিজের থাকতে চাওযার ইচ্ছেগুলো মাঝেমাঝে এমন কত য়ে অন্যায় কাজ ওকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে.........সেকথা কেন বোঝেনা আনু- আর?

হায়াতে পার্টির কথা শুনেছিল সৌভিক। এত রাত হল, আসবে কিভাবে? একবার আনুর এক কলিগ ওকে ছাডতে এসেছিল এরমই রাত করে। সেদিন সৌভিক স্পষ্ট বলে দিয়েছিল যেন অন্য কারুর গাড়ীতে এভাবে আর কখনো না আসে। বরং ফোন করে দিলে ও নিজেই পৌঁছে যাবে আনতে। গ্যারাজ থেকে গাড়ীটা বার করল সৌভিক। চিন্তার পারদ ওপরে উঠছে অথচ সারা মন জুড়ে অভিমানের চোরাস্রোত দিব্যি বহমান। সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে সৌভিক পৌঁছে গেল হায়াত। নজরে না পড়ে এমন দূরত্বে গাড়ী পার্ক করে বসে রইলো সৌভিক, বসে রইলো, বসেই রইলো। কোথায় কি? সময এগোয়, মশার অত্যাচারে অস্থির সৌভিকের হাত বারবার মোবাইলের দিকে যায়, আবার রাখে.......। হঠাত্ ওর মনে পড়ল ঘরের এসিটা তো বন্ধ করেনি। তাছাড়া সৌভিক যেসময় বেড়িযেছে, তখন এ্যাদ্দুর আসার হিসেবে অনেক দেরী হয়ে গিযেছিল। হয়তো আনু তখন ফিরতি পথে, হয়তো এতক্ষণে বাড়ীতে..............

একথা মনে হতেই ফের গাড়ী ঘুরিয়ে রাতের নিঝুমে মাত্র ১৫ মিনিটেই ও পৌঁছে গেল বাড়ী। যতটা নিশ্চুপে সম্ভব ততটা শান্ত, অতল অন্ধকারকে সঙ্গী করে সৌভিক ভেতরে ঢুকলো। আলো না জ্বেলে বেডরুমে গিয়ে কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না। রাত দুটো বেজে গেছে। বারান্দার কাছে গিযে কাচের এপার থেকে দেখলো নিঃসাড় প্রতিমার মত বসে আছে আনু, ঘুমন্ত পৃথিবীর ধাত্রী য়েন। আর এই নিরিবিলি পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে যে পুলটা কখনো তেমনভাবে নজরেই পড়েনি ওর, তা এক অদ্ভুত তন্ময়তা নিয়ে ধরা দিল সৌভিকের চোখে। মনে হল ওটা আছে বলেই এখানে থাকাটা অর্থবহ। চারতলার এই উঁচু থেকে ফ্লাইওভার একটা কল্কা আঁকা সাড়ীর পাড়ের মত লাগছে আজ। মনে হল একস্ট্রা পয়সা না দিয়েও এই য়ে শিল্পিত সমৃদ্ধি অমনি পেয়েছে, তা ও ভাগ্যবান বলেই। ভাস্কর্যের ভারে, প্রাচুর্য্যে আর ডানা মেলা উড়াল নিযে পুলের এই প্রোভোকেটিং এ্যাপ্রোচে বারান্দাটা যে সবচেযে ধনী, তা আজই বুঝলো সৌভিক। ওর ইচ্ছে হল আনুর কাছে গিয়ে পাশে বসতে, মাথায় হাত রেখে বলতে- আজ থেকে তুমি আনু নও; প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞা, একলা আমার কাছে একলা তুমি আমার পূর্ণপ্রজ্ঞা। কিন্তু কিছুই বললো না সৌভিক, কিছুই করলো না। স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকলো পর্দার খুঁটকে মুঠিতে ভরে, আবছায়াকে সঙ্গী করে- ঘরের ভিতরে। কে য়েন মাটীর সঙ্গে আঁকড়ে রেখে দিল পা।

পুলের ওপর দিযে এই রাতেও বিন্দু-বিন্দু আলো মুখে ছুটে যাচ্ছে ট্রাক। ছড়ানো হ্যালোজেন আলোয় রাস্তা মায়াময় লাগার কথা ছিল কিন্তু লাগছে না। সন্ধ্যে থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় ঝরাপাতা, ধূলো-বালী মেখে পুল ধোঁয়া-ধোঁয়া, চিপচিপে। আঁধির মত ধাঁধানো রাস্তা দিয়ে ছোট গাড়ীগুলো তীরবেগে ছুটছে। কোনো ডেফিনিট ডেস্টিনেশনে পৌঁছতে চায়।

দূর থেকে এবার যে গাড়ীটা এল, সেটা ভিজে-ভিজে লাগছে না। চকচক করছে, গাড়ীর সাইড লাইটগুলোও জ্বলছে। খুশীর জল ছড়িয়ে একদম মাথা উঁচু করে ছুটছে গাড়ী। তার মানে বৃষ্টি হচ্ছে কাছেই। আসছে, আসছে, এতক্ষণে আসছে তাহলে...............।

ঝুপ্পুস বৃষ্টিতে আপ্রাণ ভিজবার আকাঙ্খা নিয়ে পুল আকাশের দিকে হাত বাড়ালো। বাড়ালো না? তেমনই তো যেন মনে হল পূর্ণার।

Thursday, July 9, 2009

এ’ প্রাপ্তি, এ’ পুণ্য


মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী


আজ পনেরো-ষোলো বছর ধরে একটা ভারী পূণ্যের কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নেয় সদু। বহুদিন আগে মোটে মাসখানেক মত রেশন তোলার কাজ করেছিল ও। তখন থাকতো এখানে। ছোটখাট চেহারা, ভারী কাজ পারতো না। যে যা হাল্কা-ফুল্কা কাজ দিত তাই-ই করতো কোনোমতে। ওকে দেখতে ছিল খানিকটা ‘হাঞ্চ ব্যাক অফ নোতরদাম‘ এর ‘কোয়াসিমোদোর‘ মত। একপিঠ কুঁজ। সামনে ঝুঁকে হাঁটতো। একদিন খুব হই-হল্লার আওয়াজে বারান্দায বেড়িয়ে দেখি রিক্সায় চড়ে সদু চলেছে, পাশে লাল কাপড়ের পুঁটুলীসুলভ এক বেঁকাচোরা কন্যে। তিনফুট-ই সদুর আড়াইফুটি বৌয়ের গরবে সদুর হাস্যমুখর মুখ তখন ‘কি করেছি দেখ’-র ঔদ্ধত্যে উড়াল নিয়েছে আকাশে। খালপাড়ের বাচ্চাগুলো রিক্সার পিছনে লাফালাফি করতে-করতে চলেছে 100 আর সদু পাড়া ঘুরে বৌ দেখাচ্ছে। যে যা দিচ্ছে তা‘তেই খুশী। না দিলেও সদু বৌ প্রাপ্তির দরাজ দিল-এ রাজা এখন। মুখ থেকে হাসি আর মুছছেই না। সেই সদু বিয়ের পরে আর আসেনা কাজে। মনে ভাবি হনিমুন-টুন হচ্ছে বোধহয়, আসবে, আসবে, আসবে। ওমা, অপেক্ষাই সার। কোথায় সদু? এলো, তবে পূজোয়। দু-দুটো বছর পর, সঙ্গে সেই লালপুঁটুলী। তবে কন্যে কেমন যেন উড়োচুলো, হতদ্দশা আর আরও বেঁকাচোরা। কোলে এক কালোপুঁটুলী ন্যাংটাখোকা। কিন্তু সদু যেন সদ্যফোটা কদমফুল। বেশ ডাঁটোসাঁটো চেকনাই চেহারায় চর্ব্বির চকমকি। শুনলুম বিয়ে করে বৌয়ের বাপের বাড়ীর দেশ বসিরহাটেই নাকি সংসার পেতেছে।
জিজ্ঞেস করলুম- কেন গো? চাষবাস করছো বুঝি, বৌয়ের বাপের জমি আছে?
: জমি? কি যে বল? আমার থিকেও ওর হালত্ খারাপ। মা মরতেই বাপটো পলালো আর একা পাইয়া লক্ষীরে সব ঢ্যাকরাগুলান ফুসলাতো। সেই জন্যি তো সকাল-সকাল বিয়ে করতি হল।
: তাহলে?
: কি তাইলে?
: মানে চলে কি করে তোমার? রোজগার-পাতি কি?
: ঐ একটা মন্দিরে নক্ষী বাসন মাজে, ন্যাতালেপে আর আমি যা পাই ভিক্যেসিক্যে করি....... গেরাম তো, খচ্চা কম।
: কিন্তু ভিক্ষে কেন। এখানে তো তুমি কাজ করতে সদু.....
: এখন বৌ যা করে, তাইতি হুয়ে যায়।
: হলেই বা, তোমার তো কিছু করা দরকার।
: করছি তো, ভিক্যে.........! বললাম না গেরাম। শওরের মত কাজকাম কই?
: এখানে চলে এসো তা‘হলে।
: অব্যিস চলে গ্যাচে গো দিদি, আর ইচ্চেটিচ্চে নেই।
: ভিক্ষেও তো তোমার অভ্যেস ছিল না সদু..........
চুপ করে পায়ের দিকে তাকিযে থাকে সদু, উত্তর নেই।
খানিক পরে লক্ষী বলে- ছেলেটোকে একটা জামা দিবে দিদি? শীত আসতিছে......
হঠাত্ সদু যেন প্রাণ ফিরে পায় চাওয়ার কথাতেই। ধড়মড়িযে বলে- দুধের পয়সাটা বল নক্ষী, না খাইয়ে কদ্দিন রাকবি?
এবার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পালা বৌয়ের।
আমি বললাম-
: কেন ও তোমার কাছে খায়না? নেহাত্ই তো শিশু দেখছি, মাস আট-দশ হবে বোধহয়।
: আমার দুধ আসেনা গো দিদি। আবার পোয়াতি হইছি না।
আমি তো থ, হতভম্ব। মনে হল মারি সদুকে টেনে দুটো থাপ্পড়। অবশ্য বলব কাকে, যেমন দেবা তেমনি দেবী। গপ্প বাকী ছিল আরো। ইনিয়ে-বিনিয়ে লক্ষী এ‘বার বলল-
: পেরথমটা তো হবার সময় গলায় নাড়ী জইড়ে মরলো। সেইডা মেয়ে ছিল। পাড়ার নোকেরা বললো এইডা মেয়েছেলে তো- গেচে ভালই। এই নক্ষণ ভাল। দেখিস্, পরেরটা ছেলেই হবে। তবে একবচ্ছরের মধ্যি হতি হবে। বেশী পরে এই হিসেব নাকি গুইলে যাবে গো দিদি।

মেয়ে হয়ে সদ্য মরা নাকি ভাল লক্ষণ, ছেলে হবার উদ্দেশ্যে। উঃ। জীবনভর এ’ কি অপমান নিত্যসঙ্গী আমাদের এই মেয়ে-প্রাণগুলোর। সয়না, সয়না। তবু উপায়ও তো হয় না। মানিয়ে-মুনিয়ে, দ্বিতীয় শ্রেণীর মনুষ্যজন্মের অনুকম্পায় ক্ষইতে-ক্ষইতে চলতেই হয় আমাদের, চলতে হচ্ছেই। নিজেকে বোঝাতে বলি- মন দুঃখ ছুঁয়ে থাকলে, বুকের ব্যথাগুলো অন্য সাজে সৃষ্টির কাছে যায়। তুই কর কিছু, লেখ কিছু সোনা বরং দুঃখ পাস্ না। এ’তটা জীবন মেপে এসে আজও কান্না?
তা সে যাই হোক্, ফিরে আসি ওদের কথায়। এই দু‘বছরে লক্ষীর একটি মেয়ে হয়েই মরেছে, তারপর এই ছেলেটি ও ফের লক্ষী ভরাভর্ত্তি। জিজ্ঞেস আর করা হল না- মিটেছিল তো আশা, আবার তবে পেট ভরালি কেন?
এতক্ষণে লক্ষীর শ্রীহীনতার আন্দাজ ও সদুবাবুর চেকনাই-এর হিসেব পেলুম। মাগো, মা। অন্তরাত্মা ককিয়ে ধিক্কার-ধ্বনিতে চীত্কার করে উঠলো। মেয়ে জন্ম কেন, কেন? বরের সুখের কারণে, পাড়া-পড়শীর বলার কারণে না কোনোমতে বেঁচেবর্তে থাকা একটা ঠিকানার কারণে লক্ষী লক্ষীছাড়া? ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলুম। খুব কি আলাদা ওদের থেকে আমরা, খুব কি? শুধু বুদ্ধি দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে আর সচেতনতা দিয়ে আগলে রেখেছি, আড়ালে রেখেছি আমাদের ঐ লক্ষীছাড়া মুখ। তাই বোধহয় এমন নড়ে গেলুম কোথাও।

অবশেষে সাধ্যমত কিছু তো দিলাম। টাকা, কাপড়, ইস্-তিস্, বেডকভার। এরপর ওরা গেল ও এলো ফের পরের বছর। চাহিদা এবার তেল-সাবান-স্যুটকেশ অবধি। ভাঙাচোরা হলেও হবে, ওরা সারিয়ে-সুরিয়ে নেবে। কিন্তু চাই মানে চাই। পরের বছর, পরের বছর, ও এমনি অনেক পরের বছর পার করে বারবার, ফিরে-ফিরে। ঠেলেঠুলে পূন্যের কাজ এ’ভাবে কত যে সদু করিয়ে নিয়েছে আমাকে দিয়ে তার শেষ নেই। ক্রমশঃ বেড়েছে জোর, অধিকারের ‘এটা না ওটা’র বায়নাক্কা, ছাতা-জুতো-তেল-ফিতে-খেলনা-র মত হাবজী-গুবজী জিনিসেরও অফুরন্ত আবদার। চলছিল এ’ভাবেই। একবার সদু এলো হঠাত্ এক অদ্ভুত আর্জী নিয়ে। মনে পড়ে, সেটা ছিল অষ্টমীর দিন। সদু এসেছে, এসেছে ওর বৌ আর সঙ্গে জনা চারেক ছেলে(হ্যাঁ, ছেলেই। জানিনা মেয়েগুলোকে কি করলো। যার দু-বছরেই দুটির পরও একটিতে ভরা-পেট ছিল, তার এই সাত বছরে চারটি এবং চারটিই ছেলে? বিশ্বাস হয় না, যাই হোক্)।ও প্রস্তুতি বিনা, ভূমিকা বা ভান-ভনিতা বিনা ধড়াম করে বলল-
: দিদি তোমার বাড়ীতে আমরা থাইতে এইলাম।
ওমা জিজ্ঞাসা-পত্র নয়, একদম ঘোষণা। আমি বলি-
: তা কি করে হয় সদু, এটা কি আমার বাড়ী? আমার শ্বশুর-শাশুড়ী আছেন।
: সে তুমি বুঝো, এ বচ্ছর তোমারে টাকা-পয়সা-ঘটি-বাটী-কাপড়-জামা কিচ্ছু দিতি হবে না, খালি থাইতি দাও।
: আমি বরং প্রতি বছর যা দিই তার চেয়ে তোমায় বেশী দেব সদু। এমন উল্টো আবদার করোনা।
: এমনভাবে আমাদের তাড়ায়েও না গো দিদি।
অস্থির আমি হাঁকপাঁক করে বলি-
: আরে, তাড়াবার কথা তো পরে, আগে প্রশ্নই তো উঠুক এমন চাওয়ার।

ইতিমধ্যে সদুর তিন ছেলে পকেট থেকে গুলি বার করে খেলতে শুরু করেছে রাস্তায় আর একজন টলটলে পায়ে কখনো হাঁটছে, কখনো পড়ছে আবার কিছু মুখে তুলে পরমানন্দে কচকচ করে চিবোচ্ছে। আর বৌ? নির্বিকার আড়াইফুটি শ্রীহীন লক্ষী যেন আরো ছোট্টখাট্টো আরো বেভ্ভুলো, আরো আনমনা হয়ে গেছে। মন দিয়ে মাথার উড়োচুল হাতড়ে উকুন টেনে আনছে যত্নে আর নখের আগায় পুটুস্-পুটুস্ মারছে।
অন্যমনস্ক আমাকে ফের বাস্তবে এনে ফেললো সদুর চীত্কার।

: এই পটল, মাদুরটা আন্, আন। খেলাডা থো। দাদার সঙ্গি হাত ধরাধরি কইরা পাতিলটা আন। ওর মধ্যি চাল আছে, দ্যাখস্, পইড়্যা না যায়- সাবধান.................
: তার মানে? তুমি এসব কোথায় আনতে বলছো সদু?
: ক্যান বিতরে!
: সম্ভব নয়। বললাম না এটা আমার বাড়ী নয়।
: আরে শ্বশুরবাড়ী মানেই তুমার বাড়ী। আমি কিচ্ছু শুনবো না। কয়ডা দিনের পরই তো চইল্যা যাবো গো। এই শুধু শ্যামাপূজানটুক্।

কি অবলীলায় অধিকারের হিসেব বোঝালো সদু। যে সম্মানবোধ হীনতা ওকে দীন করলেও প্রাপ্তির ঘর পূর্ণ করার রাস্তা দেখিয়েছে তা আমার আজও অর্জন করা হয়ে ওঠেনি। অহংকার করার মত নিজেকে উচ্চতা দিতে পারিনি আবার ফুটোবুকের অহংকার মাড়িয়ে যেতে দিতেও খুব আপত্তি আমার। তাই ‘পাছে লোকে কিছু বলে......... ‘ ভেবেই ভয়ে-ভয়ে কেটে গেল দিন অন্য দীনতায়। তবু দেখানো তো চলে না এ’সব। ও আমায় কল্পতরু জানে, জানে রাজপ্রাসাদের রানী। তাই সব সামলানোর দায় আমাতে স্থাপনা করে অধিকারের ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছে। এখন বল আমার কোর্টে আর নেই। জানি, জানি। আমার আস্কারা, আমার ওকে বোঝা-বুঝির এ্যাটিচ্যুড থেকেই ওর এই শক্তি তৈরী হয়েছে। তবু....... কারুকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজের আশ্রয় নিয়ে তো দ্বিধায় পড়া চলে না। সুতরাং..........
: তুমি জেদ কোরনা সদু।
: আমার উপায় কিছু নাই গো দিদি।
: কেন? এ পাড়ায় তোমার এত চেনাজানা। তাছাড়া আগে এখানে থাকতে যে জায়গায়, সেখানে যাও।
: থাকতি পেলি কি আর বসিরহাটে যাতাম? সেই কবে বাড়ীখান পেমোটিং হই গ্যাচে।
: তো বছর বছর এখানে এসে ওঠো কোথায়?
: ঐ কালীমন্দিরের কাছে বাসগুমটীতে থাকি আর মন্দিরের পেসাদ খাই। দু’বেলাই ভাত দেয় গো দিদি। আর ডাল, ভাজা বাদে একটা লাবড়াও। ওরা তো আমায় সেই ন্যাংটা থেকে চেনে......
: সেটা কথা নয়। কালীবাড়ীতে রোজ অন্ততঃ পঁচিশ-তিরিশজনকে আমি খেতে দেখেছি। কিন্তু কথা হল তুমি কেন জায়গা ছাড়ছো?
: ছাড়ছি নাতো। খাতি ওখানে যাব, সারাদিন ওখানেই থাইবো। শুধু দিদি রাতের বেলাটুক্।
: কেন? এত বছর যদি ওখানেই এসে উঠেছো তবে এবারে নয় কেন?
: ছিলম তো দিদি। ওখেনেই তো উঠেছিলম। ঐ কান্ড না ঘইটলে কি আর তোমায়...........।
চুপ করে গেল সদু, স্থির। পায়ের দিকে নজর রেখে একদম স্থির।
: কান্ড মানে?
: এই তো দেখছো নক্ষীরে, কী দশা। বুঝসুঝ্ নাই। ঐ বাসগুমটীর ডেরাইভার, কন্ডাক্টোর, হেল্পার সব ভোগ করতিছে নক্ষীরে। আমি জানতিই পারিনি। এই তো কালই রাতের বেলা একটা দাড়িমুখো নোক বৌ-এর পা ধরে নাড়া দেচ্ছিল। আমার ঘুম ভাঙিছে দেখে সে শালা দৌড়ে পলালো। আর নক্ষীর সে কি রাগ মোর ওপর। বলে- ‘কেন ওকে তাড়াইলি, আমারে যে নোকগুলান খাতি দেয়, ভালবাসা দেয়। তুই কি দিছিস্ ভিখারী?’
: এ কি কথা? সত্যি কি ও বোঝেনা?
: জানিনা দিদি। এক এক সময় কাঁদে আমারে জাপ্টে ধইরা। কাল রাইতে অমন ব্যাভার করার পর, আজ সকালে বলে ‘শালা খানকীর পোলাগুলান....... আমি কাইট্যা ফ্যালামু। আমারে শোয়াইবা, তোমার মাগ পাইছো? আর একবার নাড়ায়ে দেখ আমারে...........।’

আমি স্তব্ধবাক, শুন্যবোধে দেখতে থাকি উকুন বাছতে থাকা লক্ষীকে। নির্লিপ্তির শেষ আশ্রয়ে যেন সুখে ঘর বেঁধেছে মেয়ে। আমি ঠিক করে ফেললাম, থাকতে ওদের দেবই। তা’তে এই বাড়ীর মানুষজনের সঙ্গে কিছু চীটিং-এর আশ্রয় আমায় নিতে হবে হয়তো, তবু.........। কারণ পারমিশনের উত্তরে যে ‘না’-টা আমায় শুনতে হবে, তা আমি মানাতে পারবো না যেমন, তেমন ওদেরও এই দুঃসময়ে ঠেলতে পারবো না দূরে। সুতরাং..............
সুতরাং ওকে বললাম-
: এক কাজ করো সদু। গাড়ীটা এখন সার্ভিসে গেছে, গ্যারাজ ফাঁকা, ফের আসতে মাস পুরোবে। আমি ওখানের তালা খুলে রাখবো, তুমি বেশ রাত করে চুপচাপ এসে শুয়ে যেও আর ভোর হতেই কড়া দুটোয় তালাটা ফের লাগানো আছে এমনিভাবে ঝুলিয়ে রেখে বেড়িয়ে যেও। আমি সময়মত চাবী বন্ধ-খোলা করে নেব’খন। খালি একটাই চিন্তা। তোমার লক্ষীরানী চেঁচামেচী করে যদি, কি হবে তখন?
উত্সাহের আতিশয়্যে সদু বলে-
: ও আমি মুখ চেপ্পে ধরবো নে........ তা’ছাড়া আমি থাইলে দিদি ও আমার সঙ্গেই ঘুরঘুর করে। ঠিকঠাক খাতি পেলে আর মাথাডা টানি ধরি উকুনডো বাছি দিলে এত্ত খুশী থায়ে কি বলবো। ও চিন্তা তুমি কোরো না কো। আমি ঠিক ম্যানিজ করবো।

এরপর এইভাবে ঘরের সঙ্গে লুকোচুরি আর পরের সঙ্গে দোস্তি জমিয়ে ভয়ে-ভয়ে কেটে গেল দিন আমাদের- নিরুপদ্রবে। এ কাজে পূণ্য কি আছে? হয়তো আছে। হয়তো অসহায়ের সহায় হওয়ার পূণ্য? তবে তা আমার আপন ইচ্ছেয় নয়। এ’ যদি পূণ্যের কাজ হয়, এখানেও তা’ জোর করে সদু করিয়ে নিয়েছে আমাকে দিয়ে।

এই পূজোতেও সদু এসেছিল ওর পাগলী বৌ আর বেঁচেখুঁচে থাকা গোটা ছয়েক অপোগন্ডো নিয়ে। আমি শুধু সদুর লক্ষীরানীকে রাতের বেলায় সামনের ঘেরা বারান্দাটায় শুতে দিলাম। কি করব, এ’ বারে যে ওরা এক কন্যাসন্তান নিয়ে এসেছে। মনে ভাবি- বেশ তো ছিলি, হঠাত্ এই কন্যা অবধি কেন এলি? এত দুর্মূল্য ধনকে মতিভ্রমের লক্ষী কি পারবে সামলাতে? কিন্তু কখনো-কখনো ভিতরঘর থেকে বাইরের বারান্দায় নজর গেলে দেখি, লক্ষী কন্যামুখ পানে সতৃষ্ণ নয়নে নিবিষ্ট মনে চেয়ে আছে তো আছেই। অপত্যস্নেহ এমন দুর্লভ অপ্রাকৃত উত্সারণ, অন্তঃস্থিত এমন এক ইন্সটিঙক্ট, যে লক্ষী দিব্যি তার ভার দু’হাতে সামলাচ্ছে, সুখ কুড়োচ্ছে। পাগলামী মাথায় তুলে বরং কন্যাকোলেই রাত কাটাচ্ছে, গান শোনাচ্ছে, চুলে বিলি কাটা সোহাগ রাখছে। ভোর হতেই অথচ ব্যস্ত সমস্ত কাঁথাকানী সামলে, বারান্দা ধুয়েমুছে চলে যাচ্ছে নিজ-উল্লাস-পুরের অস্থায়ী ঠিকানায়। বাকী পরিবার যে সব বাসগুমটিতে। তারপর সারাদিনের হিসেব ওদের ভীষণই যৌথ, ভীষণই পারিবারিক। ওরা খাচ্ছে কালীবাড়ীর সেই নরনারায়ন ভোজ। আর পূজোর ক’দিন তো পাড়ার ৬-টা পূজোয় ওদের ছশো দৌড়াদৌড়ির খাওয়া-দাওয়া। কোথাও সকালের প্রসাদ, তারপরেই অন্যখানে আবার। তা সারতে না সারতেই খিচুড়ীভোগের আরেকখানে ডাক, ফের সান্ধ্য প্রসাদ ও রাতের ভোগ। সুতরাং বেশ কাটে ওদের ও’কটা দিন। খালি কাঁচা টাকা ও পার্থিব প্রয়োজনেরই যা অমিল। প্রতি পূজোয় ‘দিতেই হবে’-র দাবী নিয়ে একদম অধিকারের চিলচীত্কারে এসে দাঁড়ায় বলেই না কিছু পূণ্য কুড়োবার সুযোগ পাই। কাপড়-জামা, লেপ-তোষক, ঝাঁটা-ন্যাতা, বাসন-বালতী-র অফুরান আবদার বাড়ছে, বাড়ছে, বাড়ছেই। নতুন পুরনোর হিসেব কষাকষি নেই, তবে পেতে ওকে হবেই। এমনিতে কিচ্ছু কোথাও দিই না। এ’টুকুও যদি ওর ঠেলায় না বেড়োত, তবে কি হতো? এবার তো আবার কন্যাসন্তান সহ নিরুচ্চার বিপদ কোলে করে। ওদের এই অবুঝ, নিরুপায় বিপদের চেয়ে আমার ঘরের জনেদের সামলে নেওয়া তো অনেক সোজা। তাই কিছু ব্যক্তিগত হিসেব কষাকষির দাম মিটিয়ে দিয়ে সে দায় সামলে নিয়েছিলাম ঠিকঠাক।

আসলে আমি মানুষটা বড় গেঁতো প্রকৃতির। দয়া-দাক্ষিণ্যও করিয়ে নিতে হয়। এই ঠেলা মারা পূণ্যকাজে ঈশ্বর কি মুখ তুলে চান? জনিনা। শুধু জানি আমাদের অন্তঃস্থলে যে মানবিক জন আছে, অন্তর-মরুতে যে মরু্দ্যান আছে, জলাশয় আছে, সে’সব খুঁজে দিতে এমনি ‘সদু’দের দরকার- বারবার। অন্ততঃ নিজের কাছে নিজেকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শূন্যজনের জেদী-আহ্লাদী আবদার, পূণ্যকাজ করানোর হিসেব জানে বলেই আমাদের রুক্ষ্ মনজমিতে মাঝেমাঝে বৃষ্টি পড়ে, শিশির ভেজা ঘাসে চলার সুখ উবজে ওঠে বুকে। এ’ তো প্রাপ্তি, এ’ তো পুণ্যই।

মৃণাল

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী (বুলবুল)

আজ পদ্মকথা কই। নষ্টকথা, নষ্ট-অনুভব, সারাটা জীবনে যে কত নষ্টদিন দিল....তাই কাছেপিঠে ভাল কিছু পেলেই এখন আঁকশী আঁকড়ে ঝটাস্ টেনে ধরি। খুবই কাছের সময়সীমার এই আপাত সাদাসিধা কথা জানিনা কারুর মনোযোগে বসবে কিনা, তবে আমার কাছে তা স্বর্ণসুষমা মাখা। ভূমিকা ছেড়ে এবার তা’লে আসলে কথায় যাই।
আমার মন কখনো ঈশ্বরমুখী ছিলনা এবং হোক্ য়ে সেটা চাইতামও না। কিন্তু অচেতন, অহংকারী আমাকে তিনি এমন নাড়া দিলেন, যে এতকালের পুরুষকারে বিশ্বাসী নাস্তিক আমি পপাতধরণীতল ও আজ আস্তিকস্য আস্তিক।........তিনি যতদিন না চান, ততদিন আমরা বোধহয় একটা পাও ফেলতে পারিনা। এ বিশ্বাস আমার বসে গেছে মনে আস্টেপৃষ্ঠে। এটা বুঝেছি যে- যা যখন হবার তাই-ই তখন হয়, আমি শুধু চেষ্টাই করে যেতে পারি। যেমন অর্কুটে বেশ কিছুদিন থেকে একজন মানুষ, নাম কান্তি (যার প্রোফাইল পিকচারে ছিল রাধা-কৃষ্ণর ছবি) ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিযেই যাচ্ছিল আর আমি ইগনোর করছিলাম দিন-প্রতিদিন। আস্তিক আমি মানেই যে ঈশ্বরে মজে আছি এ’ তো নয়। আমার এখন নিজের দিকে মন। লিখছি- লোকে পড়ুক, কোরিওগ্রাফি করছি- মানুষ জানুক, সমমনস্ক জনের সঙ্গে ২/৫টা মন-লোভানো কথা কই- এই ধরণের ইচ্ছে ছিল এলোথেলো- হাজার। তাছাড়া আরো যে কি ভাবছিলাম কে জানে......মোটকথা ইচ্ছে ছিল না। সবসময়ই খুব সীমার মধ্যে রাখতে চেয়েছি আমার যোগাযোগের ক্ষেত্র। হলেই বা Scrap কথা, আমি কিছুটা হলেও তো চিনি নিজেকে; ঐ ‘খাজা খাচ্ছি, এবার গজা খাব’- য় আমার মন ওঠে না মোটে। তাই সঠিক জনকে খোঁজা, তাই দেখেও না দেখা চুপচাপ থাকা। যোগাযোগ খালি বাড়িয়েই যাব অথচ পালন করতে পারবো না- এ চাইনি, চাইও না। যাই হোক্- সে কান্তির কিন্তু কোনো ক্লান্তি ছিল না, অভিমান ছিল না যোগাযোগের নানান ধরণকে কাছে টেনে মনোয়োগে আসবার। অবশেষে তাঁকে এড়াতে লিখলাম- ‘ তোমার নাম কান্তি, অথচ কান্তশ্রীকে আড়ালে রেখেছ কেন ভাই? তোমার প্রোফাইলে দেখেছি 363 বন্ধু তোমার। বন্ধুধনে বেশ ধনী তো তুমি..... আরো কেন? আমি আসলে বন্ধু বাড়ানোর ব্যাপারে খুব হিসেবী। যাতে স্বীকৃতি দেবার পর সকলের প্রতি আমার দায়বদ্ধতাকে সামলে চলতে পারি, সেটা দেখি। তাই দ্বিধা, তাই অপেক্ষায় রাখা.........ব্যস। তোমার সঙ্গে এমন আপাত অমিল মানুষের বন্ধুত্ব….‘ ইত্যাদি-প্রভৃতি গা বাঁচানো, মন এড়ানো ফুলঝুড়ি কথার নানান মারপ্যাঁচ।
পরে লেখাটা দেখতে গিয়ে ভাবছি, এই টাইপের Scrap আমার কাছে এলে কি করতাম? এমন আপাত সরলতার সহজপাঠ হাতে ধরা আত্মম্ভরী মানুষকে ফের কি লিখতাম? সন্দেহ। কিন্তু ক্লান্তিবিহীন কান্তি জানে মিথ্যে অহংকারের ফুটো সারানো না হলে সব প্রাপ্তি সে ফাঁক গলে হাওয়ায় মিলায়। তাকে পেতে হবে, যা সে চায়। তা রাজৈশ্বর্য্যই হোক্ কিংবা বায়বীয় বন্ধুত্ব। positive, positive. একেই বলে positive ভাবনার positive দুর্বার জন। positive approach নিয়ে তাই কান্তি এল তত্ক্ষণাত্। সে লিখল-‘tumi ekbar add korey dekho ami jogajog rakhtey pari kina --- i think i shall be able to become good freind of yours. request give a trial.’ হারিপারি আমি শেষে এ্যাকসেপ্ট করে নিলাম তাকে। মনে ভাবলাম- মনোমত না হলে আপনিই সব উধাও হবে এ’ তো জানা হিসেব। সুতরাং...........
এবার দু’দিনের Scrap কথার মধ্যেই বুঝলাম ভদ্রলোক বয়ঃজ্যেষ্ঠ একজন মানুষ। এই বাবদে আমার খারাপ লাগলেও আর তখন করার নেই কিছু। তাঁকে গ্রহণ করা মাত্র তিনি আমার ব্লগ দু’টো ঘুরে এলেন (যা ধরে বেঁধেও অধিকাংশকেই নিতে পারিনি)। তাঁর কম্প্যুটার বাংলা পড়তে পারতো না বলে তিনি অসীম ধৈর্য্যে সব জেনেবুঝে ‘কম্প্যু’কে বাংলায় নিলেন, লেখাগুলো পড়লেন, আমার হেঁজিপেঁজী ভিডিওর সবগুলো দেখলেন ও একটা লিংক নিজের প্রোফাইলের ফেভারিট লিস্টেও রাখলেন। এ’ বাবদে আমি খুশী হতেই পারি, হচ্ছিলামও। স্বার্থসুখে টলোমলো, আত্মগরিমায় উঁচু বুকের ছাতি নিয়ে- একটা কি না কি করেছি-করেছি এমন চোখের কোণে তাকানো অনুকম্পা-টম্পা ভাব। Scrap প্রসঙ্গেই ভদ্রলোক জানালেন ওঁনারও ব্লগ-বিলাস-কথা। অতঃপর দয়া-দাক্ষিণ্যের সময় খুঁজে নিয়ে একদিন আমিও ঘুরতে গেলাম ওঁনার মন-উজাগর-ঘর। এবার তো আমার থ হওয়ার পালা। মানুষটার জ্ঞানের পরিধি, কর্মকুশলতা, জীবনদর্শন ও সারাবিশ্ব ঘুরে নিজেকে এই সময়ের মাপে ছেঁটেকেটে যে আপগ্রেডেশনে নিয়ে রাখা ধরণ, তা জেনে আমি সত্যি বাক্যহারা। প্রথমে য়ে ‘কান্তি’ বলে সম্বোধন করছিলাম, লজ্জায় মরতে-মরতে একধাক্কায তাকে ‘দাদা’-য় নিতে হল। এরপর একদিন দেখি আমার মেল-এ ওঁনার আরেক রিকোয়েস্ট এসে পড়ে আছে চুপচাপ। উনি এ্যস্ট্রোলজার ও আমার হরোস্কোপ দেখে বুঝতে চান কেন আমি আর্ট-এর সমগ্র পরিধিতেই এমন ঘোরাফেরা করি, স্পেশালিটি কি। তো দিলাম, ও উনিও এক বাক্যে এমন একটা জায়গায় আলো ফেললেন, যে আমার বিশ্বাস বসতে বাধ্য হল ভবিতব্যের অস্তিত্বকথায়। উনি আমার সুস্থ দেহমনের কামনায়, বাকী জীবনের সাফল্যের জন্য, চৈতন্যবোধে ঋদ্ধ হবার জন্য একটা মন্ত্র লিংক দিলেন ও বললেন একটা পার্টিকুলার ‘মন্ত্র’ উচ্চারণের কথা। কোনো চাহিদাহীন, প্রাপ্তিহীন, উদ্দেশ্যহীন....... শুধুমুধু..... খালি স্নেহ-স্নেহ হাসি-ঠাট্টা-খেলায়।
এবার বেশ খটমট মন্ত্র নিয়ে আমি তো নাকাল। একে সংস্কৃত তায় তা আবার Roman Harof-এ লেখা। অডিও-ভিডিও লিংক থাকলেও তার আবৃত্তি কি ছাতা বুঝছি সঠিক? মনে উপায় খুঁজছি......... ওমা, ফের দেখি আমার মেল-এ চুপচাপ সেই মন্ত্রপাতা উড়ে এসে আলো করে জুড়ে বসে আছে গা এলিয়ে- পা ছড়িয়ে- আহ্লাদী প্রশ্রয়কথার মতন। অতঃপর ........
আর কি? এবার ঐ সংস্কৃত শব্দকে আয়ত্ব করে নিয়ে ওঁনার বলা মত আবৃত্তি করতে আরম্ভ করলাম। কেন যে এটা দেবভাযা, গভীরভাবে তার আন্দাজ পেলাম আবৃত্তি করতে-করতেই। আমার কিছু হোক বা না হোক্, ঐ উচ্চারণের সঙ্গে নিজেকে যখন জড়াচ্ছি, শোনাচ্ছি, তখন পারিপার্শ্বে যেন ঘন্টাধ্বনি শুনছি, ধূপের গন্ধ উড়ছে হাওয়ায়। কি প্রশান্তি, কি আনন্দ-আবিষ্ট অনুভব আর কি যে একটা মন-ভাল-করে-রাখা অবস্থার ঘেরাটোপে জড়িয়ে যাচ্ছি, তা বলার নয়। আবৃত্তিতে সুন্দর করে সুর বেঁধে নিয়েছি নিজের হিসেব মত- যা আরো মনোগ্রাহী করে তুলেছে মন্ত্রকে। বহুদিন থেকে নাচে তো এমনই কত বন্দনা, স্তুতি ব্যবহার করছি, তাই সুর লাগাতে অসুবিধে হল না। এখন আমি হরিণ, এখন আমি ফড়িং, হাল্কা হাওয়ায় উড়ছি। দিব্যি দু’বেলা মন্ত্রআবেশে মস্ত্। অথচ ঐ মৃণালকান্তি (গোটা নামটা পরে জেনেছি) মানুষটা নির্বিকার, আনমনা ও ফের অন্যবন্ধু খোঁজে। মনভরা Positive energy নিয়ে, বিলোতে বেড়িযেছেন সর্বধর্মজনে। বন্ধুজনের হাতে মৃণাল তুলে না দেওয়া অবধি লোকটার স্বস্তি নেই। মানুষের মনের বাঁকাচোরা নষ্ট অলিগলির- অলিখিত, স্ব-নিয়োজিত সাফ-সুতরো-জন। ওঁনার কাছে শিখলাম- অহংকার শব্দটা কত ফাঁপা, কতখানি আত্মধ্বংসী তা। এমন কি আমিও Positive vibration- এর আওতায় এসে পড়াতে, তার অর্থও স্পষ্ট হল বেশ। বুঝি, বুঝি, সবই বুঝি, কিন্থু জীবনচর্চায় তার ইমপ্লিমেন্ট? হয়নি। হয়তো হবে কখনো...... সেই চেষ্টাতেই তো দাদার কথা মত উচ্চারণ দিয়ে ধুচ্ছি আপন বোধ, চেতনা, ফুটোবুকের অহংকার.......দিনরাত। বয়সকে জব্দ করতে পারা স্বার্থহীন মৃণালকান্তি, অহংকার অসুরকে বন্দী করতে পারা মৃণালকান্তি, ‘বন্ধুত্ব’ কথাকে যাত্যার্থ্য দেওয়া নিরভিমানী মৃণালকান্তি বেশ আছেন নিজপুরে অন্যরকম মস্ত্। তবে? কে বলেছে পৃথিবী শুধুই মন্দ ও স্বার্থজনে ভরা? এমন কিছু কান্ত মানুষ আছেন বলেই না শ্রান্ত পৃথিবীতে আজো পদ্মগন্ধ ওড়ে, মৃণাল ফোটে, ভ্রান্তি ভোলে বুলবুল।

Friday, March 20, 2009

সিমলিপাল- অজানা গান

মঞ্জুশ্রী রাযচৌধুরী ( Dancer & Choreographer)
: যাবি?
ক্লাশে একদিন হঠাত্ই বললাম।
: কোথায়, কোথায়, কোথায়?
সম্মিলিত আগ্রহস্বরে রিনরিনিয়ে উঠল ওদের পাযের ঘুঙুরগুলো। যাবি শুনেই যে সব ছুট্টে আসছে কাছে।
‘কোথায় আর, যাই চল্ বনে।’
আমি একাই হুজুগে নই। দেখি আমারই মতন খ্যাপা ওরাও প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো ‘চলো, চলো, চলো।’
ব্যস। চলো তো চলো। সঙ্গে সঙ্গে সব বসে পড়লো ক্যালেন্ডার খুলে ছুটি-দিনের রাঙা আলোর খোঁজে। পাওয়া গেল শুক্রবারের ২৩ শে জানুয়ারী থেকে সোমবারের ২৬ পর্যন্ত ৪ দিনের লাল দাগানো দিন। তখুনি কথা, তখুনি ফাইনাল ও তখুনি শুরু বুলবুলের (আমার ডাকনাম) ওড়াউড়ি। ঠিক হল যাব সিমলিপাল।
ব্যবস্থা কার?
সব ব্যবস্থাদি আমার।এ’ ভার কেউ দেয়না আমায়, আমি নিজেই তুলি কাঁধে। ঐ যে ‘যাচ্ছি-যাচ্ছি’-র গান শুনি অনবরত, তা’ কী কম? বাবাঃ। এ’ যে আমার কী ভাল লাগার ঘটনা, তা’ বলার নয়। যাবার আগের এই যে প্রস্তুতি, এই যে মনের পাকে জড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতি, সঙ্গী, কল্পনার উড়াল তাই তো আসল খুশী। দিন চারেকের ঐ হট্টগোল তো আসবে আর ফুরিয়ে যাবে অকস্মাত্। তার আগের এই উদ্ভাস তো অপরিমেয়। বেড়ানোর ওম্ আমি শুরুর সলতে পাকানো থেকে প্রদীপ শিখার কাঁপন অবধি ধীরে-ধীরে নিতে-নিতে যাই। তাই ‘একা-একা করছি, কেন করছি বা বাকীরা সাহায্য করলো না কেন’-র কোনো অনুযোগই তৈরী হয়না মনে। বেড়াতে গিযে সবার চোখে যখন খুশী ছলকে ওঠে, আমার তখন ঐ প্রাপ্তিটা অন্যদের চেযে বেশী অর্জন বলে মনে হয়। তা সে যাই হোক্, এবার তো বনবাংলোর বুকিং, ট্রেনের টিকিট, জীপের ব্যবস্থা, বনে ক’দিন কি খাবো তার লিস্ট ইত্যাদি-প্রভৃতি কত্ত কাজের হিসেব। বসে গেলাম সবকিছুকে নিয়ে সাজাতে।
ছন্দ ছিল কি?
ছিল ছিল, কিছু তো ছিলই। কিছু আবার ছিলও না। য়েমন ট্রেনের টিকিটেই ছন্দহারা আমরা কি জব্দ যে হলাম। আমি দেখেছি যে কোনো কাজই সুচারু হয়, যদি তার ছন্দটা ঠিক থাকে। যে জায়গায় আমরা ছন্দহীন, সেখানটা কিন্তু ছেড়ে কথা বলে না। আসলে সবকজনেই তো আর চাকুরে নয় যে যাব ভাবল আর ঝড়াক করে টাকাও বেড়িযে এল। এবার ‘আজ দিচ্ছি ম্যাম, কাল দিলে হবেনা, অন্যেরা দিক আগে’-র বাহানা সামলে যখন অল্পস্বল্প ফান্ড তৈরী হল, তখন হাতে আর একমাস মোটে সময়। আমি অথচ খরচ শুরু করেই দিযেছি। বনবাংলোর বুকিং সারা, ব্যবস্থা করেছি বোলেরো 9-সীটার গাড়ীর, দু’দিন অরণ্যভ্রমণ সেরে দেবকুন্ড হযে থাকবো য়ে খাসাডিহা-র ইকো-ক্যাম্পে তারও বুকিং সারা। এ’তো হোটেল নয, জঙ্গল বলে কথা। প্রত্যেকের নামে আগাম বুকিং না সারলে থাকার অনুমতিই মিলবে না। সুতরাং...........
ট্যাঁকের টাকা খরচ করছিলাম ঠিকই কিন্তু বুঝে পাচ্ছিলাম না যে কে বা ক’জন যাবে। এই টালবাহানায় যেই দেরী করেছি, ব্যস্- বালেশ্বরের টিকিট কাটতে গিয়ে পড়লাম একদম 127নং ওয়েটিং লিস্টের ফাঁপড়ে। এবার মনে-মনে নিজেকে ও ওদেরকে বোঝাতে বললাম-‘ওরে, তোরা সব ডান্সার। যখন প্রোগ্রামে নাচিস্, তখন আড়াই/তিন ঘন্টা তো কোথা দিয়ে উবে যায় বল। পারবি না আর ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে যেতে? মোটে তো সাড়ে তিনঘন্টার জার্নি।’ মুখ চুন করে ওরা আমার কথা শোনে আর আগত সেই দিনটায় ভিড়ভাট্টার মধ্যে কষ্ট সামলানোর কৌশল খোঁজে। নাচ আর নাচতে থাকা কামরায় সিধে থাকতে চাওযা শরীরের হিসেব সেম হল? আমি জানি তা নয়। তাই আত্মবিশ্বাসকে উসকে দিতে বলি- ‘উপায় কি আর, সব বুকিং সারা। এখন তীরের কাছে এসে পড়েছি, তরী আমাদের ভেড়াতেই হবে।’ ওরা মনে-মনে প্রস্তুতি দেখলাম সেরেই রেখেছে। কচিমন বলে কথা- অল্পে রঙীন, অল্পে মুখর, অল্পেই তুষ্টি। তবু কাঁচুমাঁচু মুখগুলোয় স্বর্ণকুচির উদ্ভাস দেখার লোভে আমার মন কিন্তু অন্য উপায়ও খুঁজতে থাকে। এসপ্ল্যানেড্ থেকে বারিপদার বাস ছাড়ে জানতাম, একদিন সেখানেও দৌড়লাম। বিকেল পৌনে ৪-টেয় লাস্ট বাস ছেড়ে তা’ পৌঁছবে রাত ১০টায় বারিপদা। আমাদের সাকুল্যে 4-টি দিনের একটি যদি বাসেই......নাঃ। এ’ ভাবনা ত্যাগ করলাম তত্ক্ষনাত্। আমাদের একার চোখেই তো আর ঐ চারদিনের রাঙাআলো ধরা পড়েনি, যারা অর্গানাইজড্ তারা স্বপ্নসত্যির হিসেব কষেছে আরো অনেক আগে। আমি হাঁকুপাঁকু করলেই কি দনাদ্দন যা চাই তা মিলবে? যারা অনেস্টলি ও ইগারলি চেয়েছে, ভবিতব্য তাদেরই হেল্প করবে এতো জানা হিসেব। জ্ঞানপাপীর মত সব বুঝেও মনে স্বস্তি নেই মোটে। প্রায় প্রতিদিনই একবার করে এনকোয়ারীতে ফোন করি আর এগিয়ে আসতে থাকা দিনের দিকে চেযে শ্বাস ফেলি লম্বা। পজিশান কোনোমতেই আর এগোয় না। এই করতে-করতে বেড়োবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় জানলাম- টিকিট কনফার্মড। ব্যস্।
নিশ্চিন্তির কাঁধে ভর দিয়েছিলে বুঝি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বলা যায় বেশ। মনে রাজ্যজয়ের খুশী এসে এমন বসত গড়লো, যে তার রেশ টানতে ট্রেন ফেল হবার জোগাড়। যেন ওটাই মোদ্দা হিসেব ছিল। এবার দেরী করে গেলেও রেলঅলারা গাড়ী না ছেড়ে হেঁকে হেঁকে বলবে-‘দিদি আসুন-আসুন, বসুন-বসুন, খাবেন নাকি কিছু?’ যা পাবার ছিল না, তা পেয়ে খুশীর স্বস্তি এমন নিশ্চিন্তির কাঁধে ভর দিল যে শেষ মূহুর্তে ছুটে-ছুটে-ছুটে দমহারা আমাদের ভুল গাড়ীতে তুলে রেল শোধ নিচ্ছিল আরেকটু হলেই। একে দেরী করে বেড়িয়েছি, তায় বোঁচকার ভার বিপুল। এবার টাঙিয়ে দেওযা নামের লিস্টি ও বগি নং খুঁজতে গেল একজন। আর আমার অবস্থা- এই রে পালায় বুঝি, পারলে ট্রেনের যেখানে খুশী উঠি। কারণ প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি দেখাচ্ছে আর 5 মিনিট বাকী। তীরে এসে তরী না ডোবানোর যে এক্স্যাম্পল দিযেছিলাম, তাইই যেন মুখের সামনে এখন ভেংচী-নৃত্য করছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। চোখের সামনে দিয়ে ভোরের গাড়ী এ’ভাবে পালাবে? কোনো একটায় উঠে তো পড়ি, পরে স্থিতু হয়ে নাহয় খোঁজা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। উঠে পড়লাম হাঁকপাঁক করে যে বগির দরজা সামনে পেলাম। এদিকে আরেক পাবলিক তো ওঠেইনি। তিনি একদম ঠিক-কামরার ঠিক-আসনে ঠিক-ভাবে বসেই ছাড়বে ভেবে দেখতে গেছেন লিস্টি। ভাগ্যিস্। শুধু এ’টুকুই কিন্তু বাঁচিয়ে দিল আমাদের। দৌড়তে–দৌড়তে সেইজন এসে পৌঁছল যেই, সেই একশো কথা শুনিয়ে তাকে বগিতে উঠিযে নিতে আমরা মরিয়া ঝাঁপালাম। চেঁচামেঁচী শুনে কামরার এক যাত্রী বলল -‘আরে করসেন কি, এই গাড়ী ‘রূপসী বাংলা’ ‘ধৌলী’ তো নয়।’ মানে? আকাশ ভেঙে পড়া মাথায় বোঁচকা চাপিয়ে ফের দৌড়-দৌড়-দৌড়। এবার যাকে কথা শুনিয়েছিলাম, এখন তারই পদাঙ্গ অনুসরণ করে ছুটছি। ঐ বিশাল লম্বা ট্রেনটার প্রায ইঞ্জিনের কাছে আমাদের কামরা, যেতে হবে অদ্দুর। প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি এ’দিকে ৬টা বাজিয়ে দিযেছে। ভুল বগিতে ভুল করে উঠেছিলাম বলে কিছু আর বলার মুখ নেই, তাই ছুটছি শুধু। হাঁপাতে-হাঁপাতে বদ্ধদমে আকাঙ্খিত কামরায় এবার পা ফেলা মাত্র গাড়ীর নাকছমাচ্ছম ছুট্। আমাদের সকলের যৌথ চাওয়ার তীব্রতাই হবে বোধহয়, ট্রেন নাহলে ৫ মিনিট লেট-এ কেন ছাড়লো? 6 টার ট্রেন ছাড়ল 6 টা বেজে5 । আমরা ছ’জব অবশেষে চললাম সিমলিপাল।
ভাগ্যিস্………! আরও কতবার?
আর মোটে একবার। ভোরের ট্রেন জুড়ে সেদিন থিকথিকে ভিড়। প্রায় এ’ওর কোলে-কাঁখালে, কিংবা বগলের ফাঁকে আটকে গিয়ে যমযন্ত্রণার টিপ্পুনী নিতে নিতে নামলাম এসে বালেশ্বর। রিজার্ভ বগির ধরণই যদি এই, না জানি জেনারেল কি ছিল? এরপর পাখীর ডানায় ভর করে যে উড়াল নিল দিন, তার সুখ বুকে বইতে-বইতে একসময় কবিতা হয়ে গেল। ও’তে যাব পরে। গদ্যে বরং ছন্দপতনের শব্দ শোনাই। ইকো ক্যাম্পের বোর্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যিনি, তাঁর সাথে গিয়ে বেশ তকতকে এক নতুন বোলেরোতে চড়া গেল। দুর্লভক্ষণের খোঁজে, ফুরফুরে হাল্কা মনে এই আনন্দিত-জনেদের নিয়ে শীত সকালের কুয়াশা ছিঁড়ে গাড়ী ৩ মিনিটেই স্পীড তুললো ১০০কি.মি পার আওযার। ড্রাইভার ওড়িয়া, নাম কাকু ও বাংলাতে বেশ পটু। সে জানালো বালেশ্বর থেকে গাড়ীতে ঘন্টাদেড়েক লাগবে বারিপদা। তারপর পিথাবটা চেকগ্যেটে নিজেদের পরিচয়ের প্রমাণ দাখিল করে বনমধ্যে আরো চার-সাড়ে চার ঘন্টার যাত্রাশেষে পৌঁছনো যাবে‘জামুয়ানী’। আমাদের বুকিং ওখানেই, 2750 স্কো.কি.মি বনের সেই একদম শেষমুড়োয়। অথচ বারিপদা না হয়ে যোশীপুর দিয়ে বনে ঢুকলে নাকি পৌনে এক ঘন্টাতেই পৌঁছে যাব বাংলোয়। বালেশ্বর থেকে যোশীপুরের রাস্তা পিচঢালা হাইওয়ে যেহেতু, গাড়ী বললো উড়েই যাবে নাকি। ‘কাকু’ বেশ জোরই করতে লাগলো আমাদের। শুরু হল এবার আমার দোনামনা। কি করি, কি করি? সমস্ত দাযিত্ব আমার যেহেতু তাই সিদ্ধান্তের ভারও আমার। ভুল হলেই ফের গুলিয়ে যাবে সব। তা’ছাড়া ছ’জনের থেকে মত চাইলে যে ছ’শো মতের আমদানী-সম্ভাবনা, তা থেকে বাছাই করে........বাপরে.......। মনে ভাবলাম, থাক, ডিসিশন নিজোই নিই। বনে এসেছি এই জঙ্গুলে এ্যামবিয়েন্সটাকেই তো চেটেপুটে নিতে। সুতরাং কেন দ্বিধা, কেন ফের অন্যপথের ভাবনা? যে পথ জানি সে পথেই যাই, হোক্ দেরী। আত্মস্থিত থেকে ও বেশ বিশ্বাসের সুরে বললাম- ‘লাগুক সময়....বনের মধ্যে দিয়েই যাব।’ এখানেও সেই ‘ভাগ্যিস্’-এরই কারুকৃতি ফের। বারিপদার পিথাবটা চেক গ্যেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে জানলাম, পারমিশন যেহেতু বারিপদার থেকে, তাই যোশীপুর দিয়ে গেলে বনে এন্ট্রিই পেতাম না। আমার আত্মপ্রত্যয়ের ক্যানভাসে এবার বাকীদের সপ্রশংস তুষ্টির ছায়া পড়লো। ভাগ্যিস্ এই রাস্তা বেছেছিলাম।
পাগল হলে চলে?
আর দেরী নয ছুটতে হবে জোর। মনমুকুরে এখন বনের ছাযাছবির ডাক। যে হুহু শব্দে গাড়ী নিয়ে দৌড়চ্ছিল কাকু, জঙ্গলে ঢুকতেই সে’ কেরামতি খতম। ঘাটরাস্তায় অজস্র ওঠা-পড়া, ঘনঘন বাঁক। বিশাল বিশাল শাল-সেগুনের গাছ, কোথাও কোথাও দঙ্গল বেঁধে যেন হাত ধরাধরি করে আগলাচ্ছে পথ। তারই ফাঁক গলে পথে লক্ষ কাটাকুটি, আলোর ছায়ামাখা আল্পনা। এই মুগ্ধতার রেশ থাকতে-থাকতেই দেখি পথের বাঁকে চোখের ওপর য়েন লাফিযে পড়ল লুলুং নদী। ভুলে গেলাম বেলা অনেক হল, ভুলে গেলাম গিযে রাঁধলে তবে খাওয়া হবে। সব ক’জনের হুটোপুটি, বনের বাঁক, নুড়ির ফাঁক গলে কোথা দিয়ে পেরিয়ে গেল সময। শেষে ‘কাকু’র ডাকে সম্বিত ফেরে। আমাদের মত ওর তো আর পাগল হলে চলে না। প্রোফেশনের প্রয়োজনে প্রকৃতির এই মোহাবেশ থেকে মুক্তি নেবার কৌশল ওকে শিখতে হয়েছে। এই আবহে তৈরী হওযা ভাপকে তাই উড়িয়ে দিতে সময় লাগলো না ওর। আমরাও আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠে বসলাম জীপে।
বিভ্রান্তি। কার?
সন্ধ্যে যখন রাতের কাছে ডিউটি বদল করছে, প্রায় এর’মই সময় এসে পৌঁছলাম ‘জামুয়ানী।’ কৃষ্ণপক্ষের রাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন ধরা দেবে হাত বাড়ালেই। এতও তারা হয় আর তা কিনা দেখা যায় এমনি খালি চোখে? মুগ্ধ সবাই ফের উন্মন, ফের চেনা আকাশের অচেনা ছন্দে দিশাহারা। এ’ছাড়া অন্য উপায়ও যে নেই। গাড়ীর হেডলাইট নেভা মাত্র ঐ ঝাঁপিয়ে পড়া অন্ধকারে নিজের হাত-পা-ই নজরে আসছে না তো বাংলো। দূ-রে একটা আলোর আভাস দেখে ওদিকে যাওয়া গেল। দেখি ওটা চৌকিদারের ঘর ও তারা আমাদের দেখে যেন বিভ্রান্ত-টালমাটাল। কি যে করবে ভেবে পাচ্ছেনা। না, এটা হবার ছিল না। আসলে মকরসংক্রান্তির পরপরই ও’দিন ছিল প্রথম হাটবার। হাঁড়িয়ায় আকন্ঠ মস্ত হয়ে ব্যোম ভোলানাথ দশা এখন সব্বার। এদিকে বাস্তব অবস্থার সামনে পড়ে সারাদিনের ক্লান্তি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আমাদের শরীরে। এ’ বলে ঘর দেখাও, ও বলে বাথরুম যাব, কেউ হাঁকে আলো দাও, নাকীসুরে ক্ষিদের বায়না তোলে কেউ তো কেউ ঐ মাঠেই শুতে চায়। একে মাথার ভিতর ওদের ভীমরুলের গুনগুন গান, তায় বাইরে থেকে এই অনভিপ্রেত চ্যাঁ-ভ্যাঁ। গ্রামের লোকাল গরীব চাষীভুষি মানুষ এরা। এখন কি যে করবে, কোথায় দাঁড়াতে দেবে বা এই সম্মিলিত চাহিদার কোনটা আগে মেটাবে তা নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো। করলো তো, কিন্তু আলোর পরিধির বাইরে গিয়ে যেই ওরা নজরহারা, শুরু হচ্ছে ফের আমাদের জল, আলো, ঘরের জন্য হাহাকার। ওরা আসলে সেই ব্যবস্থাই করছে ও তা অন্ধকারকে সঙ্গী করেই। এরিযাটা যে মুখস্থ। দূর থেকে টিউবওয়েলের ঘ্যুচুং-ঘ্যুচুং শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ভুষোমাখা লন্ঠন একটা ধরিয়ে গেল কেউ, কাঠ ফেড়ে আগুন জ্বালার চেষ্টাও শুরু হল দেখলাম। চৌকিদারের বৌমা এবার টলোমলো পায়ে একটা হেঁচকী তুলতে থাকা লন্ঠন নিয়ে চললো আমাদের ঘর দেখাতে। ও’টুকু আলোয় নজরে এলো পাশাপাশি দুটো ঘরে দুটো-দুটো করে বিছানা, সঙ্গে এ্যাটাচবাথ্ ও বাথরুমে একটি বালতী, মগ ও বেসিন। লন্ঠন যেহেতু একপীস্, তাই বাথরুমে কেউ গেলে বাকীরা অন্ধকারে ঘুপচীমুপচী হয়ে ঐ এক খাটেতেই জড়োসড়ো। শুনলাম হ্যারিকেন আছে, কেরোসিন নেই। আমরা পরদিন যখন বনমহলে বেড়োবো, তখন ঐ গাড়ীতে করে গিয়ে ওরা অন্য কোনো বাংলো থেকে তেল আনবে। বিভ্রান্তির চরম একদম। একসময় বাথরুমে যাবার পালা এলো আমার। পায়ের কাছে লন্ঠন রেখে মুখ ধুতে জল যেই ফেলেছি বেসিনে, ব্যস, ঐ শীতের রাতে পা গেল সপসপিযে ভিজে আর হেঁচকী ওঠা লন্ঠনে জল লেগে দপদপ করে তিনি দেহ রাখেন আরকী। কি হল? দেখি ওমা বেসিন আছে, পাইপ নেই। য়েহেতু তোলা জলে কাজ সারতে হবে তাই বাহুল্যবোধে পাইপ-ই আর লাগানো হয়নি।
অপ্রাপ্তি না প্রাপ্তি?
ইতিমধ্যে রাতের খাবার রেডী। সারাদিনের না খাওযার পরে যেন অমৃতভোগের গন্ধ নিযে খিচুড়ী আর ডিমভাজা এল। পেটে দানাপানী আর চোখ-সয়ে নেওযা অন্ধকারকে মনে-মনে যেই গ্রহণ করলাম, ব্যস্, আর আমাদের পায কে? মনে এমন তৃপ্তি বসল যে স-ব অপ্রাপ্তিগুলো মধুর ও এ্যাডভেঞ্চারাস লাগতে লাগলো। হাঁড়িয়া না খেয়েও শুরু হল মনে একশো ফানুসের ওড়াউড়ি। শুধু বুঝে নেবার ছিল অবস্থা ও পরিস্থিতিটা। খুশী-মন এবার আঁকড়ে ধরলো সমগ্র পরিবেশটা ও তার বাই-প্রোডাক্ট। গল্পগাছায় সময় গেল কোথা দিয়ে উড়ে কেজানে। আকাশে তারা দেখে আর জোনাকীর আলো গোনা শেষে বেশ রাত করে সব শুতে গেলাম ঘরে। পরদিন ভোরে যখন রোদের আলো, আলপথ, ধানের ক্ষেত, বয়ে যাওয়া নাম না জানা নদী, ছড়িয়ে থাকা পলাশ বিছানো পথ- এই সবটা নিয়ে ধরা দিল ‘জামুয়ানী,’ তখন আমরা আনন্দে আত্মহারা। বেড়াতে গিযে এই যে অচেনা কিছু হিসেব, অজানা ঘটতে থাকা নানান আলুথালু ঘটনা, একে যদি এ্যাডভেঞ্চার বলে, তবে তার পূর্ণ আস্বাদন দিল সিমলিপাল। এই মাপের প্রাপ্তিবোধের জন্য অবশ্য সবার মন প্রস্তুত নয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের ক’জনার মনের তার ছিল একই সুরে বাঁধা।
কি চাও, নিজস্ব রঙ না সাজানো ঢঙ?
যেখানে কিছুটা ফাঁকা মালভূমি মত এরিয়া আছে, কাছাকাছি নদীজলের উত্স আছে, সেখানে মাত্রই 4/6 ঘরের যে গ্রাম, তারই কাছাকাছি বাংলোগুলোর অবস্থান। বনদপ্তরের মনোভাব এ’ব্যাপারে খুবই যুক্তিগ্রাহ্য। বন্য পরিবেশ তার নিজস্ব রূপে থাকবে, আর বাইরের জন তুমি তার সঙ্গে এ্যাডজাস্ট করবে। অর্থাত ওদের সাজানো স্বর্গে গিযে, ওদের খুশীর মধ্যে নিজেকে স্থাপন করে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নাও তোমার আনন্দআবেশ। পশু-পাখী-বন-আদিবাসীজন সবাই চলবে-ফিরবে-ঘুমোবে তাদের নিজস্ব ঢঙে, নড়বে আপন বিভঙ্গে। চাও যদি তবে ঐ সুখ তুমি আলতো করে শুধু মেখে নিতে পারো মনে। এ’ বৃত্তান্ত আমার একদম সঠিক বলে মনে হল। কোত্থাও কোনো সাজানো রঙের বেয়াড়া হিসেব ছিল না সেখানে। সিমলিপাল সোচ্চারে জানান দিযেছে তার উপস্থিতি প্রতিদিন ভিন্নভিন্ন ছাঁদে ।

ঝর্না - পাহাড় - পাখীর কথা কখন?
বলব-বলব, ধীরে, একটু ধীরে। এরপরের তিনদিন শুধু বন, হরিণ, ঝর্ণা, পাহাড়, ওটাচ-টাওয়ার, নদী আর শুঁড়িপথে মুক্তো কুড়োনোর গল্প। এ’ গল্প চেনা, এ গল্প প্রাপ্তির। এ’গল্প শুধুই খুশীর ক্ষণগুলোকে রোয়ার, মনের গোপনে বন্দী করার ও কল্পনার তুলিতে সুচারু সাজিয়ে আপন-সঙ্গে খেলার। এই ‘সিমলিপাল-অজানা গান’-এর ক্যাপসানে ওর বসত নয়। তাই ওই খুশীকে অন্যনামে মুক্তি দেব পরে। তারচেয়ে যে সুখটা বুকে থাকতে-থাকতে কবিতা হয়ে গেল শেষে সেটাই শোনাই।
সিমলিপাল, সিমলিপাল
বনবাদাড়ে মন মাতাল।
হিমেল হাওযার পাগলামী সুখটানে,
ছয় ‘ছাগলে’ খরাক্লিষ্ট প্রাণে,
অরণ্যঘ্রাণ অঢেল ঢেলে নিলুম।

ছাগলগুলোর নাম দেবাশীষ,
সংগীতা, জয়মালা
ছাড়া
খোকন ছিল সাথে।
আর ‘মঞ্জু’র যে’জন,
বাঁধন-মরণ-ক্ষরণ,
সঙ্গী সে তো ছিলই।

বুকের খাঁচায় সবুজ-সবুজ রং মেখেছি,
মন ধুয়েছি লুলুং নদীর জলে।
সমমনা আমরা ক’জন মিলে,
টিমটিমে লন্ঠনে,
ভয় পেযেছি খুউব।

সুখ শুধু নয় ঘরে।
দুঃখরই বা এতই কোথা জোর?
যে মিলন-আকুল ইচ্ছে ছিল বুকে,
প্রকৃতির সেই রূপ-রূপালী থেকে
নিলাম আলো-ধুলো তুলে,
নিলাম দু-দশ মাসের রসদ।
এখন আমার ভিতর ‘ভিসুভিয়াস’
আমার ইচ্ছে ‘লিমুজিন।’
আগুনবুকে দৌড় শুধু দৌড়।
এখন আমি ‘যীশু’ দয়ার সাগর।
এখন আমি ‘বট’-এর মত ছায়া।
এখন আমায় দুঃখ দেবে যে,
তাকেও দেব স্বর্ণকণার মালা।

Saturday, March 7, 2009

সুখ


কারুর জন্য, কিছুর জন্য বাঁচার মধ্যে যে কি সুখ তা কি বলি। আর পাপী-তাপী-আত্মআদুরী-বিপদলোভী মানুষগুলো কিনা আমার সে সুখ কাড়ার চেষ্টা করবে আর জিতেছি ভেবে বগলবাদ্য করবে তা হতে দেওয়া যায় নাকী? পারবেই না, হারবো না আমি কিছুতেই।
আমার সেজেগুজে একলা পড়ে থাকা বাড়ীর নাম 'নির্জনে'। খুব যত্নে সাজিযেছি তাকে ভালবেসে, মনের মত করে। আমি সেখানে যাই মাঝেমাঝে। ঘরগুলোরও আমি নাম দিযেছি আমার ব্যবহারের ছন্দ বুঝে। য়েমন 'মির্চাং' হল সেই ঘরটি যেখানে আমি রিহার্সাল করি, নাচ শেখাই, নিজেও নাচি। তার পাশেই একটা প্রায় স্বপ্নের মত কাঁচ-ঘর আছে যার অনুষঙ্গ নানান পাখীর। সিঁডি় উঠে গেছে এরই গা ঘেঁষে। ঘর থেকে ঐ কাঁচ-পাখী ভেদ করে যায় দৃষ্টি অফুরান, সিঁড়ি পেরিয়ে দূরে- । সামনে আদিগন্ত বিশাল বড় মাঠ। না, না আমার না। ও সরকারের লিটিগেটেড প্রপার্টি। তা' সে যাই হোক্, আমি তো gainer. পাখী-পাখী ঘর আর সামনে উধাও মাঠ, এই ঘরের তাই নাম রেখেছি 'উড়াল'। পাশেই আছে টয়লেট- 'অধরা'। গ্যারাজে যাবার রাস্তাটুকু সেতুর মতন ঢালু করে গড়েছি আর তার তলা খুঁদে নিয়ে যে পন্ড মত হযেছে, তাতে জল রেখেছি, মাছ ছেড়েছি মৃগেল, বাটা, তেলাপিয়া, কালবোশ। এ‘ গ্যরাজের নাম- ‘আনমন‘। পাশে একচিলতে জমিতে ‘ফুলে-ফুলে ঢলে-ঢলে........ ‘ চেয়েছিলাম। কিন্তু উত্তরমুখী বাড়ী তো। তাই আমার চেষ্টার কসুর না থাকলেও তেমন ফুলেল দিন নেই। এ আমার নীচের তলার হিসেব। ওপরে উঠতেই যে ড্রইং স্পেস, তার নাম- ‘নিটোল‘। কেন তা জানিনা। আমার মনে হযেছে, ব্যস্। একটি মিউজিক রুম তার পাশেই। নাম ‘ভেঁপু‘। এটির মেঝে-দেওয়াল-আসবাব সব কাঠের ও সাজানো রুরাল-শিল্প অনুসারী। মুখোমুখি য়ে শোবার ঘর, তার নাম রেখেছি ‘জিরেন‘। পাশেই টয়লেট-‘পিছুটান‘। রান্নাঘর আলাদা করে নেই তাই সে নামহারা। আমার ড্রইং স্পেস-এর সঙ্গেই এই ওপন কিচেন। ওপরে উঠতে য়ে দোছাতি, তারও নাম জুটেছে-‘খড়কুটো‘। বেচারী কিচেন।

Any way, এ‘গুলোই তো সুখ। এইগুলোই বেঁচে থাকার ইচ্ছে, আমার সম্পদ, আমার আত্মআবেশ। ‘নির্জনে‘ গেলে, য়ে ঘরে যখন যাই, তখন সে‘ নাম ধরে তাদের ডাকি, বসি, গপ্প করি আর একদিন করে ক্লাশও করি। বাড়ীর পিছনে কেয়ারটেকারের ফ্যামিলী নিয়ে থাকার জায়গা আলাদা। তার মেযেটি ৩ বছরের। নাম -‘ঈশা‘।ঐ 'ঈশা' যখন 'পিচি' বলে ডেকে হাঁকে- 'দরজা খোলো, আমি, আমি।' তখন কি য়ে স্নেহবর্ষণ শুরু হয় বুকে........। সুখ, সুখ। এর নামটাও সুখ। ও কেউ না। কোনোদিন ওর পর্ণকুটির ছেড়ে আমার অট্টালিকায় মন যাবেনা ওর। তা'তে কি? ওর ঐ ও'টুকু মনোয়োগই য়ে কি সুখ দিচ্ছে আমায়। অন্য মেয়েদের নাচতে দেখে সেদিন বললো- 'পিচি গো, আমায় একতা ঝুমুর দেবে?' অন্যমনস্ক আমি প্রথমেই ঠিক বুঝিনি কি ওটা। জিঞ্জেস করলাম- 'কি সেটা? কানে পরে?' বললো- 'ঝুমুর গো ঝুমুর, পায়ে পরে না'! হাঁদা আমি ভাবলাম, হয়তো নূপুর বলছে। ভাবলাম, সর্বত্র তো এ' জিনিস মেলে না, কোনো লোকাল মেলা হলে নাহয় খুঁজে-পেতে দেখা যেত। তাই একটু সময় নিলাম ওর কাছে। বললাম- 'এখুনি হবে না বাবা, দু/দশদিন বাদে আনবো।' 'বিপর্যয়ে' ফিরে (এখানেই আমি থাকি। কেন এ' নাম তা অন্য প্রসঙ্গ। তবে 'নির্জনে'-র মত বাড়ীর গাযে এটা খোদা নেই, ওটা আমার দেওযা নাম আমার মনেই আছে। অন্য কোনো সময় এটা লিখব নাহয।) নবুকে ফোন করলাম।' 'এনে দিতে পারবি?' নবু বললো-'পাড়ার ঐ যুব মেলায় একবার দেখতে পারো, তবে আমার মনে হয তোমার ছাত্রীদের নাচতে দেখে ঘুঙুর চায়নি তো?' আমি এবার বুঝে গেলাম ও ধরতে পারলাম রিদমটা। কাল 'নির্জনে' গিয়েছিলাম, সঙ্গে কিছু ঘুঙুর আর দড়ি নিয়ে। বসে-বসে বাঁধলাম ঘুঙুরগুলো আর অপেক্ষায় থাকলাম- মেযে স্কুল থেকে ফেরে কখন। ৩-টে নাগাদ ফিরলো, ও যথারীতি- 'পিচি গো পিচি, দরজা খোলো, আমি, আমি।' দরজা খুলতেই মেয়ে দেখি একমুখ হাসি নিয়ে ভেতরে আসতে পা বাড়িয়েছে। ওর মা এসেছে পিছনে- 'কি মেযে দেখ দিদি, এসেই চলে এল দৌড়ে, জামা-জুতো কিচ্ছু ছাড়েনি। অন্যজামা পরে খেয়ে-দেযে আসবি নাহয়- চ'। সেই যাওয়া সন্ধ্যা ৬-টাতেও এলো না যখন, তখন পিছনে গিযে দেখি মেয়ে ঘুমচ্ছে। তারপর জাগলো ঠিকই, কিন্তু যে'ক্ষণ ঐ তিনটের সময় তৈরী হয়েছিল, তা আর হল না। ঘুমিয়ে মেয়ে নদগদে। হাজার ডাকেও না আসে, না হাসে। ব্যর্থ আমি ঘুঙুরটাকে রেখে দিলাম ও ফের এমনই কোনো এক ক্ষণের অপেক্ষায় ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে চলেও এলাম। এর থেকে এটা বুঝলাম যে যখন জীবন যা সুখের স্বর্ণকণা-কুচি দিচ্ছে, তা' তুলে নাও তক্ষুনি। পরের জন্য অপেক্ষায় সে'সময়, সে'ক্ষণ আর তৈরীই হয়না। শুধু আমার চাওয়ার তীব্রতা যেন অন্য কারুর ক্ষতির কারণ নাহয এইটুকুই দেখার, ব্যস্। আমার চেনা 'সুখগুলো' এমনই।

অসুখের দোসর


গাছ, মাছ, জবাফুল, হাস্নুহানা, খোলামাঠ, মাঠে বকের উড়াল, জুঁই-বেলী-কামিনীর সুগন্ধ নিয়ে ‘নির্জনে’ কাঁদে একা। কি করবো? ঈশ্বর কি আমাকে ভোগ দিয়েছেন যে তোকে দু’বাহুতে জড়াবো? তাই তুই একা। ধারেপাশে বসত তো দূর, জন-মনুষ্যি, কুকুর-বিড়াল কিচ্ছু ছিল না সেদিনও। শুধু গরু চরতো আর মোষের পিঠে চড়ে দূর পাড়ার কোনো স্কুল পালানো পাগল ছেলে যেত হেলেদুলে। কত সময় বর্ষার জমা জল, মোষের খুরের আগায় লেগে চিকমিকিয়ে ঝলসে উঠতো রোদের রঙ মেখে। আহা, কি নয়নশোভন না ছিল সেই মেঘলা দুপুর দিন। নানান পাখীর গানে, শামুকের নিরুত্তাপ হাঁটায়, প্রজাপতির ডানায় তুই ভোর নামতে দেখতিস্। হয়তো ঘুমতে যেতিস্ বনবিড়ালের বা শেয়ালের কোরাস গান শুনে। ‘নির্জনে’ রে, আমি যে রাতেও খুব কম থেকেছি তোর কাছে তাই ঠিকটা জানিনা আজও। তবে তোর আগে-পিছে-কোলে-কাঁখালে-ফাটলে-গর্ত্তে সাপগুলোকে নিয়ে যে ব্যোম ভোলানাথ হয়ে মস্ত্ থাকতিস্, তার হদিশ পেতুম বেশ। সাপখোপেরা তো আর মানুষ না যে ভেক ধরে লোক ঠকাবে; মাঝেমধ্যে তাদের খোলস ছাড়তে হয় আর সেই ফেলে যাওয়া ‘বেশবাস’ পড়ে থাকতো তোর চাতালে, চৌকাঠে, পাঁচিলের ধার ঘেঁষে।
‘মুস্কান’ আমার কুড়িয়ে পাওয়া কচ্ছপ ছানা ছিল। তুই কিন্তু ও বেটাকে নিয়ে খুব আহ্লাদে গলে গলে পড়তিস্। বলতে হয়না, ও’সব ঠিক বোঝা যায়। আরে বোকা, আমিও যে তোর মত একা। কোথাও না কোথাও তো মিলজুল হবেই। তাই কিনা? ‘ভালবাসা’ বড় শক্ত কথা রে। ও ভুল কখনো করিস্ না। অবশ্য এখন আর বারণ করে কি হবে? ভুল তো সেই করেইছিস্। আমার ‘মুস্কান’-কে (তোরও) তোর মাটীতে সেঁধিয়ে নিয়েছিস্। এক বেভ্ভুলো, অপোগন্ড দেখভাল করনেওয়ালা ছেলেকে ভাঁওতা দিয়ে দিব্যি............। ভাবিস্ কিছু বুঝিনা – না? ওরে আমিও য়ে তোরই মত ভালবাসার জনকে নিয়ে এ’ভাবেই নিশ্চিন্তির গর্তে সেঁধিয়েছিলাম। আমি বুঝবো না? বেশ। ভাল হলেই ভাল। চিন্তা করিস্ না। আমি তোর কাছে আসতে চেষ্টা করছি খু-উ-ব। কিন্তু ঐ যে। যারা মারলো, তাদেরই খাতির-যত্ন-আঁচানো-ছোঁচানো...........কোথা দিযে যেন কেটে যাচ্ছে দিন। এ’ আমার বিধিলিপি রে। ঈশ্বর আমায় বিনি সূতোর বাঁধনে নাচাচ্ছেন। তোর সদ্য বিকশিত অন্তরের নতুন গন্ধ আমার পাওনা নয়। আর কিনা তোরও হল তাই? আমার পরিচর্যাও তেমন করে তোর তো পাওয়া হল না। হয়তো কোনো পাপের সাজা এ’। এর ক্ষয় না হওয়া অবধি তুই আমি এই বিচ্ছেদেই থাকবো মনে হয়। ক্ষতি কি? এও তো প্রেম। এই যে জ্বালা নিয়ে, ‘আসবো-আসবো’ ভাবা নিয়ে, নাইবো-খাবো একসাথে এমন আশা নিয়ে কাটছে দিন, এলে তো তা ফুরিয়েই গেল। তাইনা? চুপ ’নির্জনে’ চুপ। এখন চুপ করে শো, আমি আলো নেভাচ্ছি। যেতে হবে সোনা। ফের আসবো বুঝলি? ‘বিপর্য়যে’ অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি সারতে হবে সব। আর পিছু টানিস্ না রে তুই। আমার ঘুচু-মুচু-শুচু-লুচু, গুগুলি-পুকুলি, আংকুটি-পাংকুটি..............চু-প। আসবো, আসবো, আসবো। হল?

Tuesday, March 3, 2009

আমার কথা

আমার কোনো বিশেষ কথা নেই- বুঝলে। তবু এটা বলি, আমি এমন একজন মানুষ, য়ে আত্মজনেদের ভাল থাকার প্রচেষ্টায নিজেকে নিঃশেষে ফুরিয়ে ফেলতে পারে, চায় ও বেঁচে থাকার শক্তি তা’তেই খুঁজে পায়। এই অবধি কথাটা সাদামাটা। এ’ তো অনেকেরই চাওয়া, অনেকেরই মিলে যাওয়া হিসেব। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য। ঈশ্বর আমায় ঘর-মানুষ-প্রেমবঞ্চিত ও পর-মানুষ-অনুরাগরঞ্জিত করে পাঠিয়েছেন। তেমন করে যা অথচ আমার চাওয়ার ছিল না। এই তোমরা নাহলে এলে কোথা থেকে আর কেনই বা ভাল বলছো আমায় যদি এই পর-মানুষ-অনুরাগরঞ্জিতা আশীর্ব্বাদী না হতাম। ঠিক আছে। আজ আমি এতেই খুশী। তবু বলি- বাড়ী ও বাড়ীর কাছের মানুষগুলো একটু ফিরে তাকালে কিন্তু আমি সবকিছু ভুলতে পারি এক নিমেষে। এটা আমার character, এটাই আমি। অবশ্য আমার প্রোফেশনও আমায় যা দিয়েছে, তা অনন্য, তা অপরিমেয় এবং তার total credit, goes to my শ্বশুরবাড়ী এ’ স্বীকার আমায় করতেই হবে। এরা প্রত্যেকে উচ্চবিত্ত মানসিকতার উঁচু তারে বাঁধা মানুষ আর আমি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের দড়িতে ঘুরপাক খাওয়া চিরচেনা ‘মা-ঠাকুমা’ মানুষ। মূল প্রভেদ ওখানেই। তা নয়তো এদের মত স্বজ্জন-জন দুর্লভ।

আমার সম্পর্কে আমি


*ভালবাসি বাংলায় ভাবতে, স্বপ্ন বুনতে, বাংলায় লিখতে, বাংলায় ঘুমোতে। *কাজে ব্যস্ত থাকার মধ্যে দিযে বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস নিই। *জীবনকে ভালবেসে আমার এগিয়ে চলা নির্ভর করে নাচ ও লেখালিখির ওপর। *আমি বহুদিন নাচ(কত্থক ও ভরতনাট্যম্)শিখেছি ও বছর 20 শেখাচ্ছি। বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল ও মিনিস্ট্রী অফ ট্যুরিজম্-এর সহায়তায় আমার নিজস্ব অর্গানাইজেশন থেকে প্রোগ্রাম করছি তাও অনেক দিন হল। আমার অর্গানাইজেশনের নাম 'ছন্দভারতী'।*আমি কবিতা লিখি, আবৃত্তি করি, গল্প লিখি, নাচ করি, নাচ শেখাই, প্রোগ্রাম করি ইত্যাদি-প্রভৃতি কলাক্ষেত্রের বিভিন্ন পরিমন্ডলে গতায়তের মধ্যে দিয়ে দিন-প্রতিদিন উত্তাপ সংগ্রহ করি ও সুস্থতাকে বাড়িয়ে তুলি।*ভীষণ মুডি ও মূল্যবোধের বাড়াবাড়িতে ভুগি।*অসম্ভব ভাবাবেগসম্পন্ন মানুষ আমি। কিছু জায়গায় তীব্র বিশ্বাস রেখে ঠকে যাওয়ার পর আজ নিজেকে পরিণত দেখতে চাই। আত্মআহ্লাদ ও আত্মআদরের মধ্যে বাঁচার প্রয়াসে আছি। আমার বড় হয়ে ওঠা ছিল 'ত্যাগী' ভাবনার বোধে ঋদ্ধ(না বদ্ধ?)। আজ বদলে যাওয়া মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে পরার্থপরতা ভুলে গিয়ে স্বার্থবোধে বাঁচা খুঁজি ও ব্যর্থ হলেও আশা রাখি - বদলাবো। *আমাকে সমমনস্ক মানুষজনের সঙ্গ স্বস্তি দেয়।*আমি বিশ্বাস করি কবি-লেখক-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ আমার ভাষায় লিখেছিলেন ও জন্মেছিলেন বাঙালী হয়ে শুধু আমার জন্য, আমার জন্য ও শুধুমাত্র আমারই জন্য। আমার পার্থিব ভুবনে ঈশ্বরের অন্যনাম রবীন্দ্রনাথ। *আমি বেড়াতে ভীষণ ভালবাসি। প্রকৃতির মধ্যে যে অপার্থিব ঈশ্বর অবস্থান করেন, আমি তাঁকে ঘনঘন ছুঁতে চাই। *যে কোনো সৌন্দর্য্য আমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। তা মানুষের মানবিক রূপ হোক্ বা বৃষ্টিধোয়া ভোরের আলোয় পাতার কোলে দুলতে থাকা টলটলে একফোঁটা জলই হোক। প্রকৃতির নিজস্ব রূপ ও সুচারু মানবিক মুখ আমাকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে।
*সংক্ষেপে এই আমি মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

Tuesday, February 3, 2009

কে বলেছে তুমি অকরুণ?

৬টা৫৪, বৃহস্পতিবার, 25 December 2008
হাঃ। কত অল্প জেনে কত বড়বড় শ্বাস ফেলি ’হায়, কিছু হল না’ বলে। যে চেতনার কথা আওড়াই মাঝেসাঝে, তার ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেয় এমন কিছুকিছু দুর্দান্ত physical work, লেখালিখি বা ভাব-ভাবনার মন-মাতানো মৌলিক প্রকাশ, যে বেকুব আমি যা পারি ও বদলে যা পেয়েছি, তা অঢেল, অপর্য়াপ্ত বলে বোধ হয়। এখুনি টিভিতে যে figure skating দেখছিলাম বা u-tube-এর through-তে বাচ্চা মেয়েগুলোর যে চাবুক-চাবুক নাচ দেখি, তা’তে করে মানতেই হবে যে আজ আমি যা, তা যত ক্ষুদ্রই হোক্, এ’টুকুও পাবার হকদারী আমার নেই, কখনো ছিল না। কে বলেছে ঈশ্বর অকরুণ? যা কিছু সে নিয়েছে, অন্যকিছু দিয়ে তাকে অন্যভাবে ভরে দিয়েছে। শুধু প্রাপ্তির দিকে চেয়ে চিলচোখে স্বার্থীর মত বসে ছিলাম বলে নজর এড়িয়ে গেছে সব। ভাবটা ছিল- ঘরেরও খাব, তলারও কুড়বো, যাবে না কিচ্ছু। তাই কখনো হয়? কি সব তৈয়ারী, কি সব ভাবনা-ঘষা-মাজা-পরিশ্রম আর তার এক্সিক্যুইশন। মধ্যবিত্ত বাঙালী হবার এই এক দোষ। অল্প খাটবো বেশী খাবো মানসিকতার থেকে মুক্তি জোটে না মোটে। আমি বেশ আছি। যা পেয়েছি ঢের। এ’ বাবদে কোনো কষ্ট পাবো না আর। বরং কিছু পেলে, চতুর্গুণ খুশী যেন খসে পড়ে আমার মনের অন্দরে-কন্দরে সন্তর্পণে। ব্যস্, ব্যস্, ব্যস্। ঈশ্বর! তুমি তুষ্টি আমায দিয়েছো ও দিয়ে যাচ্ছো অহরহ, এ’ বিশ্বাসটুকু মনের মধ্যে শুধু সদা জাগ্রত থাক্, আপাতত আমার এ’টুকুতেই হবে।