Friday, March 20, 2009

সিমলিপাল- অজানা গান

মঞ্জুশ্রী রাযচৌধুরী ( Dancer & Choreographer)
: যাবি?
ক্লাশে একদিন হঠাত্ই বললাম।
: কোথায়, কোথায়, কোথায়?
সম্মিলিত আগ্রহস্বরে রিনরিনিয়ে উঠল ওদের পাযের ঘুঙুরগুলো। যাবি শুনেই যে সব ছুট্টে আসছে কাছে।
‘কোথায় আর, যাই চল্ বনে।’
আমি একাই হুজুগে নই। দেখি আমারই মতন খ্যাপা ওরাও প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো ‘চলো, চলো, চলো।’
ব্যস। চলো তো চলো। সঙ্গে সঙ্গে সব বসে পড়লো ক্যালেন্ডার খুলে ছুটি-দিনের রাঙা আলোর খোঁজে। পাওয়া গেল শুক্রবারের ২৩ শে জানুয়ারী থেকে সোমবারের ২৬ পর্যন্ত ৪ দিনের লাল দাগানো দিন। তখুনি কথা, তখুনি ফাইনাল ও তখুনি শুরু বুলবুলের (আমার ডাকনাম) ওড়াউড়ি। ঠিক হল যাব সিমলিপাল।
ব্যবস্থা কার?
সব ব্যবস্থাদি আমার।এ’ ভার কেউ দেয়না আমায়, আমি নিজেই তুলি কাঁধে। ঐ যে ‘যাচ্ছি-যাচ্ছি’-র গান শুনি অনবরত, তা’ কী কম? বাবাঃ। এ’ যে আমার কী ভাল লাগার ঘটনা, তা’ বলার নয়। যাবার আগের এই যে প্রস্তুতি, এই যে মনের পাকে জড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতি, সঙ্গী, কল্পনার উড়াল তাই তো আসল খুশী। দিন চারেকের ঐ হট্টগোল তো আসবে আর ফুরিয়ে যাবে অকস্মাত্। তার আগের এই উদ্ভাস তো অপরিমেয়। বেড়ানোর ওম্ আমি শুরুর সলতে পাকানো থেকে প্রদীপ শিখার কাঁপন অবধি ধীরে-ধীরে নিতে-নিতে যাই। তাই ‘একা-একা করছি, কেন করছি বা বাকীরা সাহায্য করলো না কেন’-র কোনো অনুযোগই তৈরী হয়না মনে। বেড়াতে গিযে সবার চোখে যখন খুশী ছলকে ওঠে, আমার তখন ঐ প্রাপ্তিটা অন্যদের চেযে বেশী অর্জন বলে মনে হয়। তা সে যাই হোক্, এবার তো বনবাংলোর বুকিং, ট্রেনের টিকিট, জীপের ব্যবস্থা, বনে ক’দিন কি খাবো তার লিস্ট ইত্যাদি-প্রভৃতি কত্ত কাজের হিসেব। বসে গেলাম সবকিছুকে নিয়ে সাজাতে।
ছন্দ ছিল কি?
ছিল ছিল, কিছু তো ছিলই। কিছু আবার ছিলও না। য়েমন ট্রেনের টিকিটেই ছন্দহারা আমরা কি জব্দ যে হলাম। আমি দেখেছি যে কোনো কাজই সুচারু হয়, যদি তার ছন্দটা ঠিক থাকে। যে জায়গায় আমরা ছন্দহীন, সেখানটা কিন্তু ছেড়ে কথা বলে না। আসলে সবকজনেই তো আর চাকুরে নয় যে যাব ভাবল আর ঝড়াক করে টাকাও বেড়িযে এল। এবার ‘আজ দিচ্ছি ম্যাম, কাল দিলে হবেনা, অন্যেরা দিক আগে’-র বাহানা সামলে যখন অল্পস্বল্প ফান্ড তৈরী হল, তখন হাতে আর একমাস মোটে সময়। আমি অথচ খরচ শুরু করেই দিযেছি। বনবাংলোর বুকিং সারা, ব্যবস্থা করেছি বোলেরো 9-সীটার গাড়ীর, দু’দিন অরণ্যভ্রমণ সেরে দেবকুন্ড হযে থাকবো য়ে খাসাডিহা-র ইকো-ক্যাম্পে তারও বুকিং সারা। এ’তো হোটেল নয, জঙ্গল বলে কথা। প্রত্যেকের নামে আগাম বুকিং না সারলে থাকার অনুমতিই মিলবে না। সুতরাং...........
ট্যাঁকের টাকা খরচ করছিলাম ঠিকই কিন্তু বুঝে পাচ্ছিলাম না যে কে বা ক’জন যাবে। এই টালবাহানায় যেই দেরী করেছি, ব্যস্- বালেশ্বরের টিকিট কাটতে গিয়ে পড়লাম একদম 127নং ওয়েটিং লিস্টের ফাঁপড়ে। এবার মনে-মনে নিজেকে ও ওদেরকে বোঝাতে বললাম-‘ওরে, তোরা সব ডান্সার। যখন প্রোগ্রামে নাচিস্, তখন আড়াই/তিন ঘন্টা তো কোথা দিয়ে উবে যায় বল। পারবি না আর ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে যেতে? মোটে তো সাড়ে তিনঘন্টার জার্নি।’ মুখ চুন করে ওরা আমার কথা শোনে আর আগত সেই দিনটায় ভিড়ভাট্টার মধ্যে কষ্ট সামলানোর কৌশল খোঁজে। নাচ আর নাচতে থাকা কামরায় সিধে থাকতে চাওযা শরীরের হিসেব সেম হল? আমি জানি তা নয়। তাই আত্মবিশ্বাসকে উসকে দিতে বলি- ‘উপায় কি আর, সব বুকিং সারা। এখন তীরের কাছে এসে পড়েছি, তরী আমাদের ভেড়াতেই হবে।’ ওরা মনে-মনে প্রস্তুতি দেখলাম সেরেই রেখেছে। কচিমন বলে কথা- অল্পে রঙীন, অল্পে মুখর, অল্পেই তুষ্টি। তবু কাঁচুমাঁচু মুখগুলোয় স্বর্ণকুচির উদ্ভাস দেখার লোভে আমার মন কিন্তু অন্য উপায়ও খুঁজতে থাকে। এসপ্ল্যানেড্ থেকে বারিপদার বাস ছাড়ে জানতাম, একদিন সেখানেও দৌড়লাম। বিকেল পৌনে ৪-টেয় লাস্ট বাস ছেড়ে তা’ পৌঁছবে রাত ১০টায় বারিপদা। আমাদের সাকুল্যে 4-টি দিনের একটি যদি বাসেই......নাঃ। এ’ ভাবনা ত্যাগ করলাম তত্ক্ষনাত্। আমাদের একার চোখেই তো আর ঐ চারদিনের রাঙাআলো ধরা পড়েনি, যারা অর্গানাইজড্ তারা স্বপ্নসত্যির হিসেব কষেছে আরো অনেক আগে। আমি হাঁকুপাঁকু করলেই কি দনাদ্দন যা চাই তা মিলবে? যারা অনেস্টলি ও ইগারলি চেয়েছে, ভবিতব্য তাদেরই হেল্প করবে এতো জানা হিসেব। জ্ঞানপাপীর মত সব বুঝেও মনে স্বস্তি নেই মোটে। প্রায় প্রতিদিনই একবার করে এনকোয়ারীতে ফোন করি আর এগিয়ে আসতে থাকা দিনের দিকে চেযে শ্বাস ফেলি লম্বা। পজিশান কোনোমতেই আর এগোয় না। এই করতে-করতে বেড়োবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় জানলাম- টিকিট কনফার্মড। ব্যস্।
নিশ্চিন্তির কাঁধে ভর দিয়েছিলে বুঝি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বলা যায় বেশ। মনে রাজ্যজয়ের খুশী এসে এমন বসত গড়লো, যে তার রেশ টানতে ট্রেন ফেল হবার জোগাড়। যেন ওটাই মোদ্দা হিসেব ছিল। এবার দেরী করে গেলেও রেলঅলারা গাড়ী না ছেড়ে হেঁকে হেঁকে বলবে-‘দিদি আসুন-আসুন, বসুন-বসুন, খাবেন নাকি কিছু?’ যা পাবার ছিল না, তা পেয়ে খুশীর স্বস্তি এমন নিশ্চিন্তির কাঁধে ভর দিল যে শেষ মূহুর্তে ছুটে-ছুটে-ছুটে দমহারা আমাদের ভুল গাড়ীতে তুলে রেল শোধ নিচ্ছিল আরেকটু হলেই। একে দেরী করে বেড়িয়েছি, তায় বোঁচকার ভার বিপুল। এবার টাঙিয়ে দেওযা নামের লিস্টি ও বগি নং খুঁজতে গেল একজন। আর আমার অবস্থা- এই রে পালায় বুঝি, পারলে ট্রেনের যেখানে খুশী উঠি। কারণ প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি দেখাচ্ছে আর 5 মিনিট বাকী। তীরে এসে তরী না ডোবানোর যে এক্স্যাম্পল দিযেছিলাম, তাইই যেন মুখের সামনে এখন ভেংচী-নৃত্য করছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। চোখের সামনে দিয়ে ভোরের গাড়ী এ’ভাবে পালাবে? কোনো একটায় উঠে তো পড়ি, পরে স্থিতু হয়ে নাহয় খোঁজা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। উঠে পড়লাম হাঁকপাঁক করে যে বগির দরজা সামনে পেলাম। এদিকে আরেক পাবলিক তো ওঠেইনি। তিনি একদম ঠিক-কামরার ঠিক-আসনে ঠিক-ভাবে বসেই ছাড়বে ভেবে দেখতে গেছেন লিস্টি। ভাগ্যিস্। শুধু এ’টুকুই কিন্তু বাঁচিয়ে দিল আমাদের। দৌড়তে–দৌড়তে সেইজন এসে পৌঁছল যেই, সেই একশো কথা শুনিয়ে তাকে বগিতে উঠিযে নিতে আমরা মরিয়া ঝাঁপালাম। চেঁচামেঁচী শুনে কামরার এক যাত্রী বলল -‘আরে করসেন কি, এই গাড়ী ‘রূপসী বাংলা’ ‘ধৌলী’ তো নয়।’ মানে? আকাশ ভেঙে পড়া মাথায় বোঁচকা চাপিয়ে ফের দৌড়-দৌড়-দৌড়। এবার যাকে কথা শুনিয়েছিলাম, এখন তারই পদাঙ্গ অনুসরণ করে ছুটছি। ঐ বিশাল লম্বা ট্রেনটার প্রায ইঞ্জিনের কাছে আমাদের কামরা, যেতে হবে অদ্দুর। প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি এ’দিকে ৬টা বাজিয়ে দিযেছে। ভুল বগিতে ভুল করে উঠেছিলাম বলে কিছু আর বলার মুখ নেই, তাই ছুটছি শুধু। হাঁপাতে-হাঁপাতে বদ্ধদমে আকাঙ্খিত কামরায় এবার পা ফেলা মাত্র গাড়ীর নাকছমাচ্ছম ছুট্। আমাদের সকলের যৌথ চাওয়ার তীব্রতাই হবে বোধহয়, ট্রেন নাহলে ৫ মিনিট লেট-এ কেন ছাড়লো? 6 টার ট্রেন ছাড়ল 6 টা বেজে5 । আমরা ছ’জব অবশেষে চললাম সিমলিপাল।
ভাগ্যিস্………! আরও কতবার?
আর মোটে একবার। ভোরের ট্রেন জুড়ে সেদিন থিকথিকে ভিড়। প্রায় এ’ওর কোলে-কাঁখালে, কিংবা বগলের ফাঁকে আটকে গিয়ে যমযন্ত্রণার টিপ্পুনী নিতে নিতে নামলাম এসে বালেশ্বর। রিজার্ভ বগির ধরণই যদি এই, না জানি জেনারেল কি ছিল? এরপর পাখীর ডানায় ভর করে যে উড়াল নিল দিন, তার সুখ বুকে বইতে-বইতে একসময় কবিতা হয়ে গেল। ও’তে যাব পরে। গদ্যে বরং ছন্দপতনের শব্দ শোনাই। ইকো ক্যাম্পের বোর্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যিনি, তাঁর সাথে গিয়ে বেশ তকতকে এক নতুন বোলেরোতে চড়া গেল। দুর্লভক্ষণের খোঁজে, ফুরফুরে হাল্কা মনে এই আনন্দিত-জনেদের নিয়ে শীত সকালের কুয়াশা ছিঁড়ে গাড়ী ৩ মিনিটেই স্পীড তুললো ১০০কি.মি পার আওযার। ড্রাইভার ওড়িয়া, নাম কাকু ও বাংলাতে বেশ পটু। সে জানালো বালেশ্বর থেকে গাড়ীতে ঘন্টাদেড়েক লাগবে বারিপদা। তারপর পিথাবটা চেকগ্যেটে নিজেদের পরিচয়ের প্রমাণ দাখিল করে বনমধ্যে আরো চার-সাড়ে চার ঘন্টার যাত্রাশেষে পৌঁছনো যাবে‘জামুয়ানী’। আমাদের বুকিং ওখানেই, 2750 স্কো.কি.মি বনের সেই একদম শেষমুড়োয়। অথচ বারিপদা না হয়ে যোশীপুর দিয়ে বনে ঢুকলে নাকি পৌনে এক ঘন্টাতেই পৌঁছে যাব বাংলোয়। বালেশ্বর থেকে যোশীপুরের রাস্তা পিচঢালা হাইওয়ে যেহেতু, গাড়ী বললো উড়েই যাবে নাকি। ‘কাকু’ বেশ জোরই করতে লাগলো আমাদের। শুরু হল এবার আমার দোনামনা। কি করি, কি করি? সমস্ত দাযিত্ব আমার যেহেতু তাই সিদ্ধান্তের ভারও আমার। ভুল হলেই ফের গুলিয়ে যাবে সব। তা’ছাড়া ছ’জনের থেকে মত চাইলে যে ছ’শো মতের আমদানী-সম্ভাবনা, তা থেকে বাছাই করে........বাপরে.......। মনে ভাবলাম, থাক, ডিসিশন নিজোই নিই। বনে এসেছি এই জঙ্গুলে এ্যামবিয়েন্সটাকেই তো চেটেপুটে নিতে। সুতরাং কেন দ্বিধা, কেন ফের অন্যপথের ভাবনা? যে পথ জানি সে পথেই যাই, হোক্ দেরী। আত্মস্থিত থেকে ও বেশ বিশ্বাসের সুরে বললাম- ‘লাগুক সময়....বনের মধ্যে দিয়েই যাব।’ এখানেও সেই ‘ভাগ্যিস্’-এরই কারুকৃতি ফের। বারিপদার পিথাবটা চেক গ্যেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে জানলাম, পারমিশন যেহেতু বারিপদার থেকে, তাই যোশীপুর দিয়ে গেলে বনে এন্ট্রিই পেতাম না। আমার আত্মপ্রত্যয়ের ক্যানভাসে এবার বাকীদের সপ্রশংস তুষ্টির ছায়া পড়লো। ভাগ্যিস্ এই রাস্তা বেছেছিলাম।
পাগল হলে চলে?
আর দেরী নয ছুটতে হবে জোর। মনমুকুরে এখন বনের ছাযাছবির ডাক। যে হুহু শব্দে গাড়ী নিয়ে দৌড়চ্ছিল কাকু, জঙ্গলে ঢুকতেই সে’ কেরামতি খতম। ঘাটরাস্তায় অজস্র ওঠা-পড়া, ঘনঘন বাঁক। বিশাল বিশাল শাল-সেগুনের গাছ, কোথাও কোথাও দঙ্গল বেঁধে যেন হাত ধরাধরি করে আগলাচ্ছে পথ। তারই ফাঁক গলে পথে লক্ষ কাটাকুটি, আলোর ছায়ামাখা আল্পনা। এই মুগ্ধতার রেশ থাকতে-থাকতেই দেখি পথের বাঁকে চোখের ওপর য়েন লাফিযে পড়ল লুলুং নদী। ভুলে গেলাম বেলা অনেক হল, ভুলে গেলাম গিযে রাঁধলে তবে খাওয়া হবে। সব ক’জনের হুটোপুটি, বনের বাঁক, নুড়ির ফাঁক গলে কোথা দিয়ে পেরিয়ে গেল সময। শেষে ‘কাকু’র ডাকে সম্বিত ফেরে। আমাদের মত ওর তো আর পাগল হলে চলে না। প্রোফেশনের প্রয়োজনে প্রকৃতির এই মোহাবেশ থেকে মুক্তি নেবার কৌশল ওকে শিখতে হয়েছে। এই আবহে তৈরী হওযা ভাপকে তাই উড়িয়ে দিতে সময় লাগলো না ওর। আমরাও আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠে বসলাম জীপে।
বিভ্রান্তি। কার?
সন্ধ্যে যখন রাতের কাছে ডিউটি বদল করছে, প্রায় এর’মই সময় এসে পৌঁছলাম ‘জামুয়ানী।’ কৃষ্ণপক্ষের রাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন ধরা দেবে হাত বাড়ালেই। এতও তারা হয় আর তা কিনা দেখা যায় এমনি খালি চোখে? মুগ্ধ সবাই ফের উন্মন, ফের চেনা আকাশের অচেনা ছন্দে দিশাহারা। এ’ছাড়া অন্য উপায়ও যে নেই। গাড়ীর হেডলাইট নেভা মাত্র ঐ ঝাঁপিয়ে পড়া অন্ধকারে নিজের হাত-পা-ই নজরে আসছে না তো বাংলো। দূ-রে একটা আলোর আভাস দেখে ওদিকে যাওয়া গেল। দেখি ওটা চৌকিদারের ঘর ও তারা আমাদের দেখে যেন বিভ্রান্ত-টালমাটাল। কি যে করবে ভেবে পাচ্ছেনা। না, এটা হবার ছিল না। আসলে মকরসংক্রান্তির পরপরই ও’দিন ছিল প্রথম হাটবার। হাঁড়িয়ায় আকন্ঠ মস্ত হয়ে ব্যোম ভোলানাথ দশা এখন সব্বার। এদিকে বাস্তব অবস্থার সামনে পড়ে সারাদিনের ক্লান্তি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আমাদের শরীরে। এ’ বলে ঘর দেখাও, ও বলে বাথরুম যাব, কেউ হাঁকে আলো দাও, নাকীসুরে ক্ষিদের বায়না তোলে কেউ তো কেউ ঐ মাঠেই শুতে চায়। একে মাথার ভিতর ওদের ভীমরুলের গুনগুন গান, তায় বাইরে থেকে এই অনভিপ্রেত চ্যাঁ-ভ্যাঁ। গ্রামের লোকাল গরীব চাষীভুষি মানুষ এরা। এখন কি যে করবে, কোথায় দাঁড়াতে দেবে বা এই সম্মিলিত চাহিদার কোনটা আগে মেটাবে তা নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো। করলো তো, কিন্তু আলোর পরিধির বাইরে গিয়ে যেই ওরা নজরহারা, শুরু হচ্ছে ফের আমাদের জল, আলো, ঘরের জন্য হাহাকার। ওরা আসলে সেই ব্যবস্থাই করছে ও তা অন্ধকারকে সঙ্গী করেই। এরিযাটা যে মুখস্থ। দূর থেকে টিউবওয়েলের ঘ্যুচুং-ঘ্যুচুং শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ভুষোমাখা লন্ঠন একটা ধরিয়ে গেল কেউ, কাঠ ফেড়ে আগুন জ্বালার চেষ্টাও শুরু হল দেখলাম। চৌকিদারের বৌমা এবার টলোমলো পায়ে একটা হেঁচকী তুলতে থাকা লন্ঠন নিয়ে চললো আমাদের ঘর দেখাতে। ও’টুকু আলোয় নজরে এলো পাশাপাশি দুটো ঘরে দুটো-দুটো করে বিছানা, সঙ্গে এ্যাটাচবাথ্ ও বাথরুমে একটি বালতী, মগ ও বেসিন। লন্ঠন যেহেতু একপীস্, তাই বাথরুমে কেউ গেলে বাকীরা অন্ধকারে ঘুপচীমুপচী হয়ে ঐ এক খাটেতেই জড়োসড়ো। শুনলাম হ্যারিকেন আছে, কেরোসিন নেই। আমরা পরদিন যখন বনমহলে বেড়োবো, তখন ঐ গাড়ীতে করে গিয়ে ওরা অন্য কোনো বাংলো থেকে তেল আনবে। বিভ্রান্তির চরম একদম। একসময় বাথরুমে যাবার পালা এলো আমার। পায়ের কাছে লন্ঠন রেখে মুখ ধুতে জল যেই ফেলেছি বেসিনে, ব্যস, ঐ শীতের রাতে পা গেল সপসপিযে ভিজে আর হেঁচকী ওঠা লন্ঠনে জল লেগে দপদপ করে তিনি দেহ রাখেন আরকী। কি হল? দেখি ওমা বেসিন আছে, পাইপ নেই। য়েহেতু তোলা জলে কাজ সারতে হবে তাই বাহুল্যবোধে পাইপ-ই আর লাগানো হয়নি।
অপ্রাপ্তি না প্রাপ্তি?
ইতিমধ্যে রাতের খাবার রেডী। সারাদিনের না খাওযার পরে যেন অমৃতভোগের গন্ধ নিযে খিচুড়ী আর ডিমভাজা এল। পেটে দানাপানী আর চোখ-সয়ে নেওযা অন্ধকারকে মনে-মনে যেই গ্রহণ করলাম, ব্যস্, আর আমাদের পায কে? মনে এমন তৃপ্তি বসল যে স-ব অপ্রাপ্তিগুলো মধুর ও এ্যাডভেঞ্চারাস লাগতে লাগলো। হাঁড়িয়া না খেয়েও শুরু হল মনে একশো ফানুসের ওড়াউড়ি। শুধু বুঝে নেবার ছিল অবস্থা ও পরিস্থিতিটা। খুশী-মন এবার আঁকড়ে ধরলো সমগ্র পরিবেশটা ও তার বাই-প্রোডাক্ট। গল্পগাছায় সময় গেল কোথা দিয়ে উড়ে কেজানে। আকাশে তারা দেখে আর জোনাকীর আলো গোনা শেষে বেশ রাত করে সব শুতে গেলাম ঘরে। পরদিন ভোরে যখন রোদের আলো, আলপথ, ধানের ক্ষেত, বয়ে যাওয়া নাম না জানা নদী, ছড়িয়ে থাকা পলাশ বিছানো পথ- এই সবটা নিয়ে ধরা দিল ‘জামুয়ানী,’ তখন আমরা আনন্দে আত্মহারা। বেড়াতে গিযে এই যে অচেনা কিছু হিসেব, অজানা ঘটতে থাকা নানান আলুথালু ঘটনা, একে যদি এ্যাডভেঞ্চার বলে, তবে তার পূর্ণ আস্বাদন দিল সিমলিপাল। এই মাপের প্রাপ্তিবোধের জন্য অবশ্য সবার মন প্রস্তুত নয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের ক’জনার মনের তার ছিল একই সুরে বাঁধা।
কি চাও, নিজস্ব রঙ না সাজানো ঢঙ?
যেখানে কিছুটা ফাঁকা মালভূমি মত এরিয়া আছে, কাছাকাছি নদীজলের উত্স আছে, সেখানে মাত্রই 4/6 ঘরের যে গ্রাম, তারই কাছাকাছি বাংলোগুলোর অবস্থান। বনদপ্তরের মনোভাব এ’ব্যাপারে খুবই যুক্তিগ্রাহ্য। বন্য পরিবেশ তার নিজস্ব রূপে থাকবে, আর বাইরের জন তুমি তার সঙ্গে এ্যাডজাস্ট করবে। অর্থাত ওদের সাজানো স্বর্গে গিযে, ওদের খুশীর মধ্যে নিজেকে স্থাপন করে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নাও তোমার আনন্দআবেশ। পশু-পাখী-বন-আদিবাসীজন সবাই চলবে-ফিরবে-ঘুমোবে তাদের নিজস্ব ঢঙে, নড়বে আপন বিভঙ্গে। চাও যদি তবে ঐ সুখ তুমি আলতো করে শুধু মেখে নিতে পারো মনে। এ’ বৃত্তান্ত আমার একদম সঠিক বলে মনে হল। কোত্থাও কোনো সাজানো রঙের বেয়াড়া হিসেব ছিল না সেখানে। সিমলিপাল সোচ্চারে জানান দিযেছে তার উপস্থিতি প্রতিদিন ভিন্নভিন্ন ছাঁদে ।

ঝর্না - পাহাড় - পাখীর কথা কখন?
বলব-বলব, ধীরে, একটু ধীরে। এরপরের তিনদিন শুধু বন, হরিণ, ঝর্ণা, পাহাড়, ওটাচ-টাওয়ার, নদী আর শুঁড়িপথে মুক্তো কুড়োনোর গল্প। এ’ গল্প চেনা, এ গল্প প্রাপ্তির। এ’গল্প শুধুই খুশীর ক্ষণগুলোকে রোয়ার, মনের গোপনে বন্দী করার ও কল্পনার তুলিতে সুচারু সাজিয়ে আপন-সঙ্গে খেলার। এই ‘সিমলিপাল-অজানা গান’-এর ক্যাপসানে ওর বসত নয়। তাই ওই খুশীকে অন্যনামে মুক্তি দেব পরে। তারচেয়ে যে সুখটা বুকে থাকতে-থাকতে কবিতা হয়ে গেল শেষে সেটাই শোনাই।
সিমলিপাল, সিমলিপাল
বনবাদাড়ে মন মাতাল।
হিমেল হাওযার পাগলামী সুখটানে,
ছয় ‘ছাগলে’ খরাক্লিষ্ট প্রাণে,
অরণ্যঘ্রাণ অঢেল ঢেলে নিলুম।

ছাগলগুলোর নাম দেবাশীষ,
সংগীতা, জয়মালা
ছাড়া
খোকন ছিল সাথে।
আর ‘মঞ্জু’র যে’জন,
বাঁধন-মরণ-ক্ষরণ,
সঙ্গী সে তো ছিলই।

বুকের খাঁচায় সবুজ-সবুজ রং মেখেছি,
মন ধুয়েছি লুলুং নদীর জলে।
সমমনা আমরা ক’জন মিলে,
টিমটিমে লন্ঠনে,
ভয় পেযেছি খুউব।

সুখ শুধু নয় ঘরে।
দুঃখরই বা এতই কোথা জোর?
যে মিলন-আকুল ইচ্ছে ছিল বুকে,
প্রকৃতির সেই রূপ-রূপালী থেকে
নিলাম আলো-ধুলো তুলে,
নিলাম দু-দশ মাসের রসদ।
এখন আমার ভিতর ‘ভিসুভিয়াস’
আমার ইচ্ছে ‘লিমুজিন।’
আগুনবুকে দৌড় শুধু দৌড়।
এখন আমি ‘যীশু’ দয়ার সাগর।
এখন আমি ‘বট’-এর মত ছায়া।
এখন আমায় দুঃখ দেবে যে,
তাকেও দেব স্বর্ণকণার মালা।

3 comments:

মেঘ said...

চমৎকার লাগলো।

মাল্যবান said...

সত্যি বলছি, এতো ভালো একটি ভ্রমণকাহিনী বহুদিন পড়িনি। এর শুরু থেকে যে বিভিন্ন স্পন্দনের মধ্য দিয়ে আপনি এঁকেছেন যে একটানা না পড়ে কেউ শেষ করতে পারবে না। টিকিট না পাওয়ার উদ্বেগ,ট্রেন ধরবার সেই উত্তেজনার ক্ষণ, লুলুং নদী,রাতে পৌছনোর পর বাংলোর অবস্থা সবকিছু এতো নিপুন ,ঝরঝরে গদ্যে লিখেছেন যে আপনাদের পুরো ভ্রমণটা যেন নিজে উপভোগ করলাম ।
ছাপা হয়ে প্রকাশযোগ্য কাহিনী।

Unknown said...

"এখন আমায় দুঃখ দেবে যে,
তাকেও দেব স্বর্ণকণার মালা। "
মন এমনি উদার হয়ে যায় প্রকৃতির রাজ্যে গেলে। আমাদের আশেপাশে এই পরিবেশ আছহে কি ?