Thursday, July 9, 2009

এ’ প্রাপ্তি, এ’ পুণ্য


মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী


আজ পনেরো-ষোলো বছর ধরে একটা ভারী পূণ্যের কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নেয় সদু। বহুদিন আগে মোটে মাসখানেক মত রেশন তোলার কাজ করেছিল ও। তখন থাকতো এখানে। ছোটখাট চেহারা, ভারী কাজ পারতো না। যে যা হাল্কা-ফুল্কা কাজ দিত তাই-ই করতো কোনোমতে। ওকে দেখতে ছিল খানিকটা ‘হাঞ্চ ব্যাক অফ নোতরদাম‘ এর ‘কোয়াসিমোদোর‘ মত। একপিঠ কুঁজ। সামনে ঝুঁকে হাঁটতো। একদিন খুব হই-হল্লার আওয়াজে বারান্দায বেড়িয়ে দেখি রিক্সায় চড়ে সদু চলেছে, পাশে লাল কাপড়ের পুঁটুলীসুলভ এক বেঁকাচোরা কন্যে। তিনফুট-ই সদুর আড়াইফুটি বৌয়ের গরবে সদুর হাস্যমুখর মুখ তখন ‘কি করেছি দেখ’-র ঔদ্ধত্যে উড়াল নিয়েছে আকাশে। খালপাড়ের বাচ্চাগুলো রিক্সার পিছনে লাফালাফি করতে-করতে চলেছে 100 আর সদু পাড়া ঘুরে বৌ দেখাচ্ছে। যে যা দিচ্ছে তা‘তেই খুশী। না দিলেও সদু বৌ প্রাপ্তির দরাজ দিল-এ রাজা এখন। মুখ থেকে হাসি আর মুছছেই না। সেই সদু বিয়ের পরে আর আসেনা কাজে। মনে ভাবি হনিমুন-টুন হচ্ছে বোধহয়, আসবে, আসবে, আসবে। ওমা, অপেক্ষাই সার। কোথায় সদু? এলো, তবে পূজোয়। দু-দুটো বছর পর, সঙ্গে সেই লালপুঁটুলী। তবে কন্যে কেমন যেন উড়োচুলো, হতদ্দশা আর আরও বেঁকাচোরা। কোলে এক কালোপুঁটুলী ন্যাংটাখোকা। কিন্তু সদু যেন সদ্যফোটা কদমফুল। বেশ ডাঁটোসাঁটো চেকনাই চেহারায় চর্ব্বির চকমকি। শুনলুম বিয়ে করে বৌয়ের বাপের বাড়ীর দেশ বসিরহাটেই নাকি সংসার পেতেছে।
জিজ্ঞেস করলুম- কেন গো? চাষবাস করছো বুঝি, বৌয়ের বাপের জমি আছে?
: জমি? কি যে বল? আমার থিকেও ওর হালত্ খারাপ। মা মরতেই বাপটো পলালো আর একা পাইয়া লক্ষীরে সব ঢ্যাকরাগুলান ফুসলাতো। সেই জন্যি তো সকাল-সকাল বিয়ে করতি হল।
: তাহলে?
: কি তাইলে?
: মানে চলে কি করে তোমার? রোজগার-পাতি কি?
: ঐ একটা মন্দিরে নক্ষী বাসন মাজে, ন্যাতালেপে আর আমি যা পাই ভিক্যেসিক্যে করি....... গেরাম তো, খচ্চা কম।
: কিন্তু ভিক্ষে কেন। এখানে তো তুমি কাজ করতে সদু.....
: এখন বৌ যা করে, তাইতি হুয়ে যায়।
: হলেই বা, তোমার তো কিছু করা দরকার।
: করছি তো, ভিক্যে.........! বললাম না গেরাম। শওরের মত কাজকাম কই?
: এখানে চলে এসো তা‘হলে।
: অব্যিস চলে গ্যাচে গো দিদি, আর ইচ্চেটিচ্চে নেই।
: ভিক্ষেও তো তোমার অভ্যেস ছিল না সদু..........
চুপ করে পায়ের দিকে তাকিযে থাকে সদু, উত্তর নেই।
খানিক পরে লক্ষী বলে- ছেলেটোকে একটা জামা দিবে দিদি? শীত আসতিছে......
হঠাত্ সদু যেন প্রাণ ফিরে পায় চাওয়ার কথাতেই। ধড়মড়িযে বলে- দুধের পয়সাটা বল নক্ষী, না খাইয়ে কদ্দিন রাকবি?
এবার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পালা বৌয়ের।
আমি বললাম-
: কেন ও তোমার কাছে খায়না? নেহাত্ই তো শিশু দেখছি, মাস আট-দশ হবে বোধহয়।
: আমার দুধ আসেনা গো দিদি। আবার পোয়াতি হইছি না।
আমি তো থ, হতভম্ব। মনে হল মারি সদুকে টেনে দুটো থাপ্পড়। অবশ্য বলব কাকে, যেমন দেবা তেমনি দেবী। গপ্প বাকী ছিল আরো। ইনিয়ে-বিনিয়ে লক্ষী এ‘বার বলল-
: পেরথমটা তো হবার সময় গলায় নাড়ী জইড়ে মরলো। সেইডা মেয়ে ছিল। পাড়ার নোকেরা বললো এইডা মেয়েছেলে তো- গেচে ভালই। এই নক্ষণ ভাল। দেখিস্, পরেরটা ছেলেই হবে। তবে একবচ্ছরের মধ্যি হতি হবে। বেশী পরে এই হিসেব নাকি গুইলে যাবে গো দিদি।

মেয়ে হয়ে সদ্য মরা নাকি ভাল লক্ষণ, ছেলে হবার উদ্দেশ্যে। উঃ। জীবনভর এ’ কি অপমান নিত্যসঙ্গী আমাদের এই মেয়ে-প্রাণগুলোর। সয়না, সয়না। তবু উপায়ও তো হয় না। মানিয়ে-মুনিয়ে, দ্বিতীয় শ্রেণীর মনুষ্যজন্মের অনুকম্পায় ক্ষইতে-ক্ষইতে চলতেই হয় আমাদের, চলতে হচ্ছেই। নিজেকে বোঝাতে বলি- মন দুঃখ ছুঁয়ে থাকলে, বুকের ব্যথাগুলো অন্য সাজে সৃষ্টির কাছে যায়। তুই কর কিছু, লেখ কিছু সোনা বরং দুঃখ পাস্ না। এ’তটা জীবন মেপে এসে আজও কান্না?
তা সে যাই হোক্, ফিরে আসি ওদের কথায়। এই দু‘বছরে লক্ষীর একটি মেয়ে হয়েই মরেছে, তারপর এই ছেলেটি ও ফের লক্ষী ভরাভর্ত্তি। জিজ্ঞেস আর করা হল না- মিটেছিল তো আশা, আবার তবে পেট ভরালি কেন?
এতক্ষণে লক্ষীর শ্রীহীনতার আন্দাজ ও সদুবাবুর চেকনাই-এর হিসেব পেলুম। মাগো, মা। অন্তরাত্মা ককিয়ে ধিক্কার-ধ্বনিতে চীত্কার করে উঠলো। মেয়ে জন্ম কেন, কেন? বরের সুখের কারণে, পাড়া-পড়শীর বলার কারণে না কোনোমতে বেঁচেবর্তে থাকা একটা ঠিকানার কারণে লক্ষী লক্ষীছাড়া? ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলুম। খুব কি আলাদা ওদের থেকে আমরা, খুব কি? শুধু বুদ্ধি দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে আর সচেতনতা দিয়ে আগলে রেখেছি, আড়ালে রেখেছি আমাদের ঐ লক্ষীছাড়া মুখ। তাই বোধহয় এমন নড়ে গেলুম কোথাও।

অবশেষে সাধ্যমত কিছু তো দিলাম। টাকা, কাপড়, ইস্-তিস্, বেডকভার। এরপর ওরা গেল ও এলো ফের পরের বছর। চাহিদা এবার তেল-সাবান-স্যুটকেশ অবধি। ভাঙাচোরা হলেও হবে, ওরা সারিয়ে-সুরিয়ে নেবে। কিন্তু চাই মানে চাই। পরের বছর, পরের বছর, ও এমনি অনেক পরের বছর পার করে বারবার, ফিরে-ফিরে। ঠেলেঠুলে পূন্যের কাজ এ’ভাবে কত যে সদু করিয়ে নিয়েছে আমাকে দিয়ে তার শেষ নেই। ক্রমশঃ বেড়েছে জোর, অধিকারের ‘এটা না ওটা’র বায়নাক্কা, ছাতা-জুতো-তেল-ফিতে-খেলনা-র মত হাবজী-গুবজী জিনিসেরও অফুরন্ত আবদার। চলছিল এ’ভাবেই। একবার সদু এলো হঠাত্ এক অদ্ভুত আর্জী নিয়ে। মনে পড়ে, সেটা ছিল অষ্টমীর দিন। সদু এসেছে, এসেছে ওর বৌ আর সঙ্গে জনা চারেক ছেলে(হ্যাঁ, ছেলেই। জানিনা মেয়েগুলোকে কি করলো। যার দু-বছরেই দুটির পরও একটিতে ভরা-পেট ছিল, তার এই সাত বছরে চারটি এবং চারটিই ছেলে? বিশ্বাস হয় না, যাই হোক্)।ও প্রস্তুতি বিনা, ভূমিকা বা ভান-ভনিতা বিনা ধড়াম করে বলল-
: দিদি তোমার বাড়ীতে আমরা থাইতে এইলাম।
ওমা জিজ্ঞাসা-পত্র নয়, একদম ঘোষণা। আমি বলি-
: তা কি করে হয় সদু, এটা কি আমার বাড়ী? আমার শ্বশুর-শাশুড়ী আছেন।
: সে তুমি বুঝো, এ বচ্ছর তোমারে টাকা-পয়সা-ঘটি-বাটী-কাপড়-জামা কিচ্ছু দিতি হবে না, খালি থাইতি দাও।
: আমি বরং প্রতি বছর যা দিই তার চেয়ে তোমায় বেশী দেব সদু। এমন উল্টো আবদার করোনা।
: এমনভাবে আমাদের তাড়ায়েও না গো দিদি।
অস্থির আমি হাঁকপাঁক করে বলি-
: আরে, তাড়াবার কথা তো পরে, আগে প্রশ্নই তো উঠুক এমন চাওয়ার।

ইতিমধ্যে সদুর তিন ছেলে পকেট থেকে গুলি বার করে খেলতে শুরু করেছে রাস্তায় আর একজন টলটলে পায়ে কখনো হাঁটছে, কখনো পড়ছে আবার কিছু মুখে তুলে পরমানন্দে কচকচ করে চিবোচ্ছে। আর বৌ? নির্বিকার আড়াইফুটি শ্রীহীন লক্ষী যেন আরো ছোট্টখাট্টো আরো বেভ্ভুলো, আরো আনমনা হয়ে গেছে। মন দিয়ে মাথার উড়োচুল হাতড়ে উকুন টেনে আনছে যত্নে আর নখের আগায় পুটুস্-পুটুস্ মারছে।
অন্যমনস্ক আমাকে ফের বাস্তবে এনে ফেললো সদুর চীত্কার।

: এই পটল, মাদুরটা আন্, আন। খেলাডা থো। দাদার সঙ্গি হাত ধরাধরি কইরা পাতিলটা আন। ওর মধ্যি চাল আছে, দ্যাখস্, পইড়্যা না যায়- সাবধান.................
: তার মানে? তুমি এসব কোথায় আনতে বলছো সদু?
: ক্যান বিতরে!
: সম্ভব নয়। বললাম না এটা আমার বাড়ী নয়।
: আরে শ্বশুরবাড়ী মানেই তুমার বাড়ী। আমি কিচ্ছু শুনবো না। কয়ডা দিনের পরই তো চইল্যা যাবো গো। এই শুধু শ্যামাপূজানটুক্।

কি অবলীলায় অধিকারের হিসেব বোঝালো সদু। যে সম্মানবোধ হীনতা ওকে দীন করলেও প্রাপ্তির ঘর পূর্ণ করার রাস্তা দেখিয়েছে তা আমার আজও অর্জন করা হয়ে ওঠেনি। অহংকার করার মত নিজেকে উচ্চতা দিতে পারিনি আবার ফুটোবুকের অহংকার মাড়িয়ে যেতে দিতেও খুব আপত্তি আমার। তাই ‘পাছে লোকে কিছু বলে......... ‘ ভেবেই ভয়ে-ভয়ে কেটে গেল দিন অন্য দীনতায়। তবু দেখানো তো চলে না এ’সব। ও আমায় কল্পতরু জানে, জানে রাজপ্রাসাদের রানী। তাই সব সামলানোর দায় আমাতে স্থাপনা করে অধিকারের ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছে। এখন বল আমার কোর্টে আর নেই। জানি, জানি। আমার আস্কারা, আমার ওকে বোঝা-বুঝির এ্যাটিচ্যুড থেকেই ওর এই শক্তি তৈরী হয়েছে। তবু....... কারুকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজের আশ্রয় নিয়ে তো দ্বিধায় পড়া চলে না। সুতরাং..........
: তুমি জেদ কোরনা সদু।
: আমার উপায় কিছু নাই গো দিদি।
: কেন? এ পাড়ায় তোমার এত চেনাজানা। তাছাড়া আগে এখানে থাকতে যে জায়গায়, সেখানে যাও।
: থাকতি পেলি কি আর বসিরহাটে যাতাম? সেই কবে বাড়ীখান পেমোটিং হই গ্যাচে।
: তো বছর বছর এখানে এসে ওঠো কোথায়?
: ঐ কালীমন্দিরের কাছে বাসগুমটীতে থাকি আর মন্দিরের পেসাদ খাই। দু’বেলাই ভাত দেয় গো দিদি। আর ডাল, ভাজা বাদে একটা লাবড়াও। ওরা তো আমায় সেই ন্যাংটা থেকে চেনে......
: সেটা কথা নয়। কালীবাড়ীতে রোজ অন্ততঃ পঁচিশ-তিরিশজনকে আমি খেতে দেখেছি। কিন্তু কথা হল তুমি কেন জায়গা ছাড়ছো?
: ছাড়ছি নাতো। খাতি ওখানে যাব, সারাদিন ওখানেই থাইবো। শুধু দিদি রাতের বেলাটুক্।
: কেন? এত বছর যদি ওখানেই এসে উঠেছো তবে এবারে নয় কেন?
: ছিলম তো দিদি। ওখেনেই তো উঠেছিলম। ঐ কান্ড না ঘইটলে কি আর তোমায়...........।
চুপ করে গেল সদু, স্থির। পায়ের দিকে নজর রেখে একদম স্থির।
: কান্ড মানে?
: এই তো দেখছো নক্ষীরে, কী দশা। বুঝসুঝ্ নাই। ঐ বাসগুমটীর ডেরাইভার, কন্ডাক্টোর, হেল্পার সব ভোগ করতিছে নক্ষীরে। আমি জানতিই পারিনি। এই তো কালই রাতের বেলা একটা দাড়িমুখো নোক বৌ-এর পা ধরে নাড়া দেচ্ছিল। আমার ঘুম ভাঙিছে দেখে সে শালা দৌড়ে পলালো। আর নক্ষীর সে কি রাগ মোর ওপর। বলে- ‘কেন ওকে তাড়াইলি, আমারে যে নোকগুলান খাতি দেয়, ভালবাসা দেয়। তুই কি দিছিস্ ভিখারী?’
: এ কি কথা? সত্যি কি ও বোঝেনা?
: জানিনা দিদি। এক এক সময় কাঁদে আমারে জাপ্টে ধইরা। কাল রাইতে অমন ব্যাভার করার পর, আজ সকালে বলে ‘শালা খানকীর পোলাগুলান....... আমি কাইট্যা ফ্যালামু। আমারে শোয়াইবা, তোমার মাগ পাইছো? আর একবার নাড়ায়ে দেখ আমারে...........।’

আমি স্তব্ধবাক, শুন্যবোধে দেখতে থাকি উকুন বাছতে থাকা লক্ষীকে। নির্লিপ্তির শেষ আশ্রয়ে যেন সুখে ঘর বেঁধেছে মেয়ে। আমি ঠিক করে ফেললাম, থাকতে ওদের দেবই। তা’তে এই বাড়ীর মানুষজনের সঙ্গে কিছু চীটিং-এর আশ্রয় আমায় নিতে হবে হয়তো, তবু.........। কারণ পারমিশনের উত্তরে যে ‘না’-টা আমায় শুনতে হবে, তা আমি মানাতে পারবো না যেমন, তেমন ওদেরও এই দুঃসময়ে ঠেলতে পারবো না দূরে। সুতরাং..............
সুতরাং ওকে বললাম-
: এক কাজ করো সদু। গাড়ীটা এখন সার্ভিসে গেছে, গ্যারাজ ফাঁকা, ফের আসতে মাস পুরোবে। আমি ওখানের তালা খুলে রাখবো, তুমি বেশ রাত করে চুপচাপ এসে শুয়ে যেও আর ভোর হতেই কড়া দুটোয় তালাটা ফের লাগানো আছে এমনিভাবে ঝুলিয়ে রেখে বেড়িয়ে যেও। আমি সময়মত চাবী বন্ধ-খোলা করে নেব’খন। খালি একটাই চিন্তা। তোমার লক্ষীরানী চেঁচামেচী করে যদি, কি হবে তখন?
উত্সাহের আতিশয়্যে সদু বলে-
: ও আমি মুখ চেপ্পে ধরবো নে........ তা’ছাড়া আমি থাইলে দিদি ও আমার সঙ্গেই ঘুরঘুর করে। ঠিকঠাক খাতি পেলে আর মাথাডা টানি ধরি উকুনডো বাছি দিলে এত্ত খুশী থায়ে কি বলবো। ও চিন্তা তুমি কোরো না কো। আমি ঠিক ম্যানিজ করবো।

এরপর এইভাবে ঘরের সঙ্গে লুকোচুরি আর পরের সঙ্গে দোস্তি জমিয়ে ভয়ে-ভয়ে কেটে গেল দিন আমাদের- নিরুপদ্রবে। এ কাজে পূণ্য কি আছে? হয়তো আছে। হয়তো অসহায়ের সহায় হওয়ার পূণ্য? তবে তা আমার আপন ইচ্ছেয় নয়। এ’ যদি পূণ্যের কাজ হয়, এখানেও তা’ জোর করে সদু করিয়ে নিয়েছে আমাকে দিয়ে।

এই পূজোতেও সদু এসেছিল ওর পাগলী বৌ আর বেঁচেখুঁচে থাকা গোটা ছয়েক অপোগন্ডো নিয়ে। আমি শুধু সদুর লক্ষীরানীকে রাতের বেলায় সামনের ঘেরা বারান্দাটায় শুতে দিলাম। কি করব, এ’ বারে যে ওরা এক কন্যাসন্তান নিয়ে এসেছে। মনে ভাবি- বেশ তো ছিলি, হঠাত্ এই কন্যা অবধি কেন এলি? এত দুর্মূল্য ধনকে মতিভ্রমের লক্ষী কি পারবে সামলাতে? কিন্তু কখনো-কখনো ভিতরঘর থেকে বাইরের বারান্দায় নজর গেলে দেখি, লক্ষী কন্যামুখ পানে সতৃষ্ণ নয়নে নিবিষ্ট মনে চেয়ে আছে তো আছেই। অপত্যস্নেহ এমন দুর্লভ অপ্রাকৃত উত্সারণ, অন্তঃস্থিত এমন এক ইন্সটিঙক্ট, যে লক্ষী দিব্যি তার ভার দু’হাতে সামলাচ্ছে, সুখ কুড়োচ্ছে। পাগলামী মাথায় তুলে বরং কন্যাকোলেই রাত কাটাচ্ছে, গান শোনাচ্ছে, চুলে বিলি কাটা সোহাগ রাখছে। ভোর হতেই অথচ ব্যস্ত সমস্ত কাঁথাকানী সামলে, বারান্দা ধুয়েমুছে চলে যাচ্ছে নিজ-উল্লাস-পুরের অস্থায়ী ঠিকানায়। বাকী পরিবার যে সব বাসগুমটিতে। তারপর সারাদিনের হিসেব ওদের ভীষণই যৌথ, ভীষণই পারিবারিক। ওরা খাচ্ছে কালীবাড়ীর সেই নরনারায়ন ভোজ। আর পূজোর ক’দিন তো পাড়ার ৬-টা পূজোয় ওদের ছশো দৌড়াদৌড়ির খাওয়া-দাওয়া। কোথাও সকালের প্রসাদ, তারপরেই অন্যখানে আবার। তা সারতে না সারতেই খিচুড়ীভোগের আরেকখানে ডাক, ফের সান্ধ্য প্রসাদ ও রাতের ভোগ। সুতরাং বেশ কাটে ওদের ও’কটা দিন। খালি কাঁচা টাকা ও পার্থিব প্রয়োজনেরই যা অমিল। প্রতি পূজোয় ‘দিতেই হবে’-র দাবী নিয়ে একদম অধিকারের চিলচীত্কারে এসে দাঁড়ায় বলেই না কিছু পূণ্য কুড়োবার সুযোগ পাই। কাপড়-জামা, লেপ-তোষক, ঝাঁটা-ন্যাতা, বাসন-বালতী-র অফুরান আবদার বাড়ছে, বাড়ছে, বাড়ছেই। নতুন পুরনোর হিসেব কষাকষি নেই, তবে পেতে ওকে হবেই। এমনিতে কিচ্ছু কোথাও দিই না। এ’টুকুও যদি ওর ঠেলায় না বেড়োত, তবে কি হতো? এবার তো আবার কন্যাসন্তান সহ নিরুচ্চার বিপদ কোলে করে। ওদের এই অবুঝ, নিরুপায় বিপদের চেয়ে আমার ঘরের জনেদের সামলে নেওয়া তো অনেক সোজা। তাই কিছু ব্যক্তিগত হিসেব কষাকষির দাম মিটিয়ে দিয়ে সে দায় সামলে নিয়েছিলাম ঠিকঠাক।

আসলে আমি মানুষটা বড় গেঁতো প্রকৃতির। দয়া-দাক্ষিণ্যও করিয়ে নিতে হয়। এই ঠেলা মারা পূণ্যকাজে ঈশ্বর কি মুখ তুলে চান? জনিনা। শুধু জানি আমাদের অন্তঃস্থলে যে মানবিক জন আছে, অন্তর-মরুতে যে মরু্দ্যান আছে, জলাশয় আছে, সে’সব খুঁজে দিতে এমনি ‘সদু’দের দরকার- বারবার। অন্ততঃ নিজের কাছে নিজেকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শূন্যজনের জেদী-আহ্লাদী আবদার, পূণ্যকাজ করানোর হিসেব জানে বলেই আমাদের রুক্ষ্ মনজমিতে মাঝেমাঝে বৃষ্টি পড়ে, শিশির ভেজা ঘাসে চলার সুখ উবজে ওঠে বুকে। এ’ তো প্রাপ্তি, এ’ তো পুণ্যই।

2 comments:

coffeehouseraddablog said...

আপনি কফি হাউসের আড্ডায় লিখতে পারেন তো ... coffeehouseradda.com

Anonymous said...

পাপ পূণ্য জানিনা, মানবিকতার অনেক উর্ধে এটা বলতে পারি। অসাধারণ লেখনী আপনার। শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না। আপনাকে সাধুবাদ সব কিছুর জন্যেই।